বজ্রযান, কৌলমার্গ, নবনাথ সম্প্রদায় যে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটা ভাববার সময় এখন এসেছে। সভ্যতার কূলে কূলে অনেক আধ্যাত্মিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তন্ত্রের এই পূর্ণতা এক দিনের ঘটনা নয়, যদিও তা খ্রিস্টপরবর্তী ৮ম শতাব্দীর প্রথম পর্বে সূচিত হল যুগপুরুষ স্বয়ম্ভূনাথ/শম্ভুনাথ বা পদ্মসম্ভবের আচার্য-কুশলতায়।
আগে একটু দর্শন-তাত্ত্বিক আলোচনা এবং ঐতিহাসিক পটভূমিকায় না গেলে তন্ত্রের দার্শনিক বিবর্তনটি ধরা অত সহজ হবে না।
মানবমনের দুটি মূল বিভাগ – অন্তর্জগত ও বহির্জগত। মানবমন এই দুইয়ের সামঞ্জস্যে সমাসীন। কখনো অন্তর্জগত, কখনো বহির্জগত, ঢেঁকি-র মতো একবার এদিক একবার ওদিক করে মানব-কর্মবৃত্তিকে ধরে রেখেছে। প্রকৃত ধর্ম হল এই কর্মবৃত্তির প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তির উপায়। যতক্ষণ এই দোলাচল নিয়ে অজ্ঞানতা, ততক্ষণই বিশেষ শৃঙ্খলতা ধরে থাকার নামই ধর্ম। ধর্মের শৃঙ্খলতা যখন মানবমনের অপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত অহংকারের প্রবণতাকে পরিচ্ছন্ন করে আনে, ধর্মের আবিষ্কৃত প্রকৃত শৃঙ্খলতায় মানবমন যখন প্রকৃতস্থ হয় প্রকৃতি-বিজ্ঞানে, তখনই ধর্ম খসে পড়ে এবং ধর্মের অন্তরাত্মা অধ্যাত্ম রূপে প্রকাশ পায়। এই অধ্যাত্মই মানবমনের বৈষম্যরূপ অজ্ঞানতার থেকে মুক্তির শেষ পর্যায়। মানবমুক্তি কী? মানবের মনে যে মুক্তির প্রশ্ন থেকে ধর্ম, অধ্যাত্ম – মনোবিজ্ঞানের এই পর্যায়গুলো বেরিয়ে এলো, সেই মুক্তি চাওয়ার পিছনে বন্ধনটা কী? বন্ধনটা মানবমনে কর্মবৃত্তির অজ্ঞানতা। অজ্ঞানতাটা কী? অজ্ঞানতাটা হল ঐ অন্তর-বাহিরের অসামঞ্জস্য।

মানবমন দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্রিয়ানুভূতির প্রত্যক্ষজ্ঞান এবং বুদ্ধির পরোক্ষ বিচারের উপর। দেহ, প্রাণ ধরে রেখেছে প্রত্যক্ষকে। আর, আত্ম-পরিচিতি বা আমিবোধ এবং বুদ্ধি ধরে রেখেছে পরোক্ষকে। মন এই দুইয়ের মাঝে বহিরঙ্গ এবং অন্তরঙ্গের সামঞ্জস্যে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ হেঁটে চলেছে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষের ওতঃপ্রোত ক্রমানুবর্তিতায়, কার্য-কারণ সম্পর্কের বাঁধুনিতে। প্রত্যক্ষ থেকেই পরোক্ষ উদ্ভূত; আবার সেই পরোক্ষ থেকেই নতুন প্রত্যক্ষের আনাগোনা। এখানেই এসে দাঁড়াচ্ছে অন্তরের ভাবজগৎ এবং বাহিরের বস্তুজগতের টানাপোড়েন। এরা কি দুটি বিচ্ছিন্ন অবস্থা? না; এরা পরস্পর-নির্ভর এবং পরস্পরের পরিপূরক।
মানবসভ্যতার ইতিহাস হল মানবধর্মের ইতিহাস। মানবধর্ম ভৌগোলিক অবস্থা-সাপেক্ষ। এইজন্যই একদেশের লোকধর্মের সঙ্গে অন্যদেশের লোকধর্মের মিল থাকলেও একই আঙ্গিকে প্রকাশ পায় না। এই প্রাকৃতিক-পরিপ্রেক্ষিত থেকেই সমাজ-সংস্কার এবং ধর্মের বিভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই বহু দেবমানব, বহু অবতার, বহু মুনির বহু মত এবং তদানুসার বহু পথ সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাষায় – “যত মত তত পথ”। জ্ঞানের দৃষ্টিতে তাই মৌলবাদের কোনও বিচ্ছিন্ন সত্তা নেই। এটাকে মেনে নিলেই সহজ-ধর্ম প্রতিভাত হয়।
সহজ-ধর্মের পথ ধরে বিচার করতে গেলে, সামগ্রিক মানবধর্মের একটা মূল পরিকাঠামো পাওয়া যায় যেটিকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে অধ্যাত্মবিজ্ঞান। এই অধ্যাত্মবিজ্ঞান যেমন মানুষেরই আবিষ্কার তেমন বস্তুবিজ্ঞানও মানুষেরই আবিষ্কার। এই দুই আবিষ্কারের সংঘাতে না গিয়ে মানবসভ্যতার ইতিহাসকে সঠিক বিচার করতে হলে এই দুই বিজ্ঞানের পরস্পর নির্ভরতাকে স্বীকার করে নিতে হবে। এমনই স্বীকৃতির উপর দাঁড়িয়ে আছে তন্ত্রবিজ্ঞান।
এবার, মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাল রেখে ঐতিহাসিক নথি ধরে এগোতে হবে মানবধর্মের ক্রমবিবর্তনের গবেষণায়।
(চলবে…)
কুলাবধূত সৎপুরানন্দ
