প্রবন্ধমনন-অনুধাবন

কোথায় পাব সোনার বাংলা?

‘সোনার বাংলা’ আর ‘সুশাসন’ শব্দ দু’টো এখন খুব চলছে। আর চলছে ‘খেলা হবে’। অনেকে বুঝছে, অনেকে বুঝছে না। যারা বুঝছে না তাদের দলে আমি। বোকা তো, চিরকালের বোকা। কোন ছোটোবেলায় দেখেছিলাম মোটা সবুজ কাগজে প্রদীপ। হাটে কুড়িয়ে পাওয়া। তুই নিয়ে কী করবি ওটা, তোর তো ভোট নেই। এই বলে সেটা কেড়ে নিয়েছিল আমার দাদা। তারও যে ভোট নেই তখন, কিন্তু কে বলবে সে কথা, সে যে বড়ো, তার গায়ে জোর বেশি।

আমার বয়ে গেছে। জানা হয়ে গেছে প্রদীপ নির্বাচনী চিহ্ন ওদের। ওরা জনসংঘী – আমার মাস্টারমশাই বলে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, “খবরদার, ওদের পাল্লায় পড়লে ডুববি।” কেন বলেছিলেন সে কথা ভালো মনে নেই। কেবল এটুকু মনে পড়ে যে তিনি ওদের দেশভাগ নিয়ে নাচানাচি পছন্দ করতেন না। আর, দেখেছি সে মাস্টারমশাইকে সিপিআই দলের ঝান্ডা হাতে পথে।

প্রদীপ চিহ্নে ভোট পড়েনি, জিতেছিলেন সেবার শ্রী মহেন্দ্র মাহাতো মহাশয়। যাকে প্রায়ই দেখা যেত হাটে কলা-মুলো-বেগুন বিক্রেতা রূপে। জেতার পরেও। সর্বহারা হয়েও তিনি জাতীয় কংগ্রেসেই ছিলেন, কমিউনিস্টদের দলে ভেড়েননি। কদাচ তিনি দলত্যাগও করেননি। সুশাসন তো নয়ই, সোনার বাংলাও দিতে পারেননি তিনি বা তাঁর দল। সেজন্য একবার তাঁকে চেপে ধরা হল। তাঁর দল যে বলেছিল সোনার বাংলা দেবে – কৈ, কী হল তার?

তিনি বললেন, “সোনার বাংলা বলতে তোমরা বাছারা কে কী বোঝো বলো তো।” ব্যস, বেধে গেল, মতান্তর। তা থেকে মনান্তর। মহেন্দ্রবাবু তার সবজির ঝুড়ি তুলে কেটে পড়লেন সকলের সামনে দিয়ে, বিনা বাধায়। কারও কারও আগ্রহ ছিল জানার – সুশাসনের কী হল। তারা সে প্রশ্ন তোলারই সুযোগ পেলেন না।

এখন নেই জোড়া বলদ। “জোড়া বলদে দুধ নাই/ কংগ্রেসের ভোট নাই”। এসেছে ‘হাত’। তারও ভোট কমছে দেশে। ওদিকে, প্রদীপও আর নেই, এসেছে পদ্ম! তারা ভোট পাচ্ছে নাকি রামরাজত্বের প্রতিশ্রুতিতে! তবে সে অভাবগুলো তো যায়নি। এখনও ঘুরে মরি সুশাসন চেয়ে। সোনার বাংলাই বা কোথায়? ডোমপাড়ার অবনী অপবাদ মাথায় নিয়ে জেলে পচছে বিনা বিচারে – সুশাসন থাকলে এমনটা হতো? নাকি, ঐ পাড়ার শেখ মুরাদ খাদ্যের অভাব সইতে না পেরে তার জোয়ান গরুটাকে হত্যা করত? বা দু’পাতা ইংরেজি শিখে অমরপ্রসাদ গায়ে গতরে খেটে দু’পয়সা কামাতে ভিন রাজ্যে ঘর বাধতে যেত? অমন কত কি ঘটছে, ঘটে চলেছে। উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একা হয়ে যাই।

প্রতিবেশীর ছেলে সুমন বলল, “কাকা, আগে জেনে নাও সোনার বাংলা কী?”

জানার জন্য যাই কোথায়? মাস্টারমশাই আর মহেন্দ্রবাবু দুজনেই পরপারে, প্রদীপ কোম্পানিই নাকি উঠে গেছে। পদ্ম কোম্পানি ব্যস্ত ছলে-বলে- কৌশলে রাজ্য শাসনের অধিকার পেতে। ‘ঘাসফুল’ দলের লোকেরা ব্যস্ত অধিকার আঁকড়ে রাখতে। তাদের অর্বাচীন নেতারা এক এক জন এক এক রকম উত্তর দেয়। কারও উত্তর কারও সঙ্গে মেলে না। এর নামই নাকি গণতন্ত্র! হায়! শেখ মুরাদ বলে, “খেতে তো পাই, তাই যথেষ্ট।” দুটো পয়সা করেছে অরুণ, সাইকেল মেরামতির দোকান খুলে। সে বলে, “আর আমার ভাষা? আমার সংস্কৃতি? তাকে তার মতো বাঁচতে দেবে না? কেন?”

অবনীর ছেলেটা উকিলের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে আইনি পরামর্শ পেতে; অমরকে বাচাতে অমরের মেয়ে ওষুধের দোকানে ঘোরে, দোকানের ছেলেটা তার দেহের খাঁজ-ভাঁজ দেখে। তারা দু’জনেই ঘরবাঁধার মূলধন চায়, তারা কাজ চায়।

সুমন বলল, “এটাই তো আসল খেলা। খেলো।”

তাই খেলছি, নিজে নিজে একা একা।

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

ছবি – মুকুট তপাদার, ফেসবুক

About author

Articles

অধ্যাপক, সমাজকর্মী ও শিক্ষাবিদ
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
Related posts
মনন-অনুধাবনরবিবারের কলম

বাংলার গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিয়ে কি আমরা ভাবছি?

হাতে হাতে কাজ চাই,পাতে পাতে ভাত চাইজাত ধৰ্ম বাদ দে,ভুখা পেটে ভাত দে। ওরা বলছে, বলবেই তো। কাজ পায়নি যে ওরা। ওদের হয়ে বলছে অন্য কেউ? তাও মানতে বাধা নেই। ওদের আর আছে কে? অথচ,…
Read more
কলকাতাখবররাজ্য

বকেয়া ডিএ-র দাবিতে এবার সরকারের সঙ্গে ডিজিটাল অসহযোগিতার পথে কর্মীরা

অবস্থান, অনশনের পর আরও আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়াচ্ছেন ডিএ আন্দোলনকারীরা। এবার ডিজিটাল অসহযোগিতার পথে হাঁটতে চলেছেন তাঁরা। আগামিকাল অর্থাৎ শনিবার থেকেই এই নয়া পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত আন্দোলনকারী সরকারি কর্মীদের। কী এই ডিজিটাল অসহযোগিতা? আন্দোলনকারীরা জানান, সরকারি কর্মীদের…
Read more
মনন-অনুধাবনরবিবারের কলম

ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে ভাষা সন্ত্রাস

জন্ম এদেশেই, তবু আতঙ্কে দিন কাটে। বিজেপিমুক্ত বা কংগ্রেসমুক্ত ভারত নয়। আমাকে বা আমাদের ভয় দেখায় শয়নে-স্বপনে দেশের রাজনীতির ভাষা। আমরা সন্ত্রস্ত। গোলা-বন্দুকের ভয়ে নয়, আমরা সন্ত্রস্ত রাজনীতির ভাষায়। ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে ভাষা সন্ত্রাস।…
Read more

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *