সন্দীপ দত্তের সঙ্গে প্রথম কথা হয় ২০১৫ সালের কোনো এক বসন্তে। আমি তখন পাটুলির এক মেসে থাকতাম। সেদিন সন্ধেবেলা ‘আঙ্গিক’ পত্রিকা থেকে আমার নম্বর পেয়ে ফোন করেছিলেন এটা জানাতে যে, ‘আঙ্গিক’-এর ঋতুপর্ণ ঘোষ সংখ্যাটি ওঁর ভালো লেগেছে। নিজেই কয়েক কপি কিনে বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়েছেন এবং এক কপি নিজের লাইব্রেরিতেও রেখেছেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, দুই বাংলায় প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ ঋতুপর্ণ ঘোষ বিশেষ সংখ্যা করেছিল ‘আঙ্গিক’ পত্রিকা। যার সম্পাদক ছিলাম আমি। সংখ্যাটি সুনাম অর্জন করে এবং পাঠকমহলে ছড়িয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। এই আনন্দের পাশে সেদিন সন্দীপ দত্তের ফোন পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম। কারণ স্নাতক স্তরের সিলেবাসে লিটল ম্যাগাজিন অধ্যায়ে বারবার ঘুরে ফিরে আসত তাঁর নাম, তাঁর কর্মকাণ্ড। সেসব বললামও ওঁকে। বললেন, “একদিন লাইব্রেরিতে এসো”। স্বভাবগত কারণে তৎক্ষনাৎ তাঁর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রে যেতে পারিনি। গেছিলাম এক-দেড় বছর পর একটা দরকারে।
ততদিনে ঋতুপর্ণ ঘোষ সংখ্যা নিঃশেষিত হয়েছে। আমরা আবার পরিবর্ধিত সংস্করণ ছাপাবার পরিকল্পনা করছি। হঠাৎ মনে হল এখান থেকে বেরিয়ে নতুন কিছু কাজ করতে হবে। শুরু করলাম ‘নিষিদ্ধ’ সংখ্যার কাজ। এই মহাবিশ্বে যা-কিছু নিষিদ্ধ, সবকিছু নিয়েই পুঙখানুপুঙখ আলোচনা সংগ্রহ করতে ছুটে গেলাম লেখকদের বাড়ি। গেছিলাম সন্দীপদার কাছেও। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, সন্দীপবাবু ততদিনে সন্দীপদা হয়ে গেছেন। সন্দীপদা ফেরালেন না। বললেন, “তুমিই সেই সুমন সাধু? তোমাকে তো অনেক বয়স্ক ভেবেছিলাম। সাধু পদবি বলেই হয়তো আমার বয়সী ভেবে বসেছিলাম। সমবয়সী যখন মনে মনে ভেবেই নিয়েছি, তখন আমরা বন্ধু হয়ে যায় বরং। কী বলো!”

সেই শুরু হল ওঁর সঙ্গে আমার কথা বলার অভ্যাস। পত্রিকার সে সংখ্যায় নির্দিষ্ট দিনের আগেই লেখা পাঠিয়েছিলেন খামে ভরে। তারপর আরও একটি সংখ্যায় লিখেছেন। এত ব্যক্তিগত কথা বলার কারণ, সন্দীপদা আমাদের মতো তরুণকে কখনও নিরাশ করেননি। তরুণদের কাজের পাশে থেকেছেন আমৃত্যু। রাজ্যে এখন প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন মেলা, বইমেলা। সব জায়গায় তিনি ছুটে যেতেন। শেষ বয়সে ভালো হাঁটতে পারতেন না। ওই পা নিয়েই একা একা কখনও ট্রেনে, কখনও বাসে চলে যেতেন কত কত জেলা। লিটল ম্যাগাজিন মেলা হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখতেন। প্রচুর পত্রিকা কিনতেন। কেউ উপহার স্বরূপ কোনো পত্রিকা দিতে চাইলে তিনি বলতেন, এখানে কি আমার লেখা আছে? যদি না থাকে তাহলে বিনেপয়সায় নেব কেন? লিটল ম্যাগাজিন কিনে পড়ব। এই কিনে পড়ার অভ্যাসটা বাঙালি পাঠককে তিনিই করিয়েছিলেন। যেসময় কলেজ স্ট্রিটের পাতিরাম বা ধ্যানবিন্দুতে ছাপা কাগজগুলো গমগম করত, সেখানে সন্দীপদার অবদান কি কম ছিল!

লিটল ম্যাগাজিন আর বইয়ের পাঠক কি ভিন্ন? বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের চাওয়া-পাওয়া, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, মন-মানসিকতা সবকিছুরই আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা সাহিত্য কতটুকু মেটাতে পারছে সে চাহিদা! শুধুমাত্র বই পড়লেই তিনি পাঠক, আর সিনেমা বা থিয়েটার দেখলেই তিনি দর্শক? সিনেমা বা থিয়েটারটাকেও পাঠ করা যায়। যেমন বইকে দেখা যায়। এই পাঠ করা আর দেখা যেন পরিপূরক। সন্দীপদার লাইব্রেরিতে এ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা চলছে। সেখান থেকেই আঙ্গিক পত্রিকার ‘পাঠক’ সংখ্যার জন্ম। ওই সংখ্যায় সন্দীপদা লিখেছিলেন, “এইসব খাদ্য-অখাদ্য তিমিরাভিসারের পাশে প্রকাশ পায় চেহারায় চাকচিক্যহীন, মশলাদার প্রচ্ছদহীন অন্যরকম ভাবনার, চিন্তনের, মনন সমৃদ্ধ লিটল ম্যাগাজিন। তার পাঠক বহুধা, বিচিত্রগামী। সিরিয়াল পাঠক নন, সেরিব্রাল পাঠক। শিক্ষিত পাঠক। তিনি পাঁঠক নন, পাঠক। পাঠচর্চার মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হওয়াটাই তাঁর একান্ত ইচ্ছে।”

আরো পড়ুন : একক উদ্যোগে গড়া লাইব্রেরি-গবেষণা কেন্দ্র! লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সহযোদ্ধা সন্দীপ দত্ত
এই যে তিনি লিখলেন, “লিটল ম্যাগাজিনের সিরিয়াল পাঠক নন, সেরিব্রাল পাঠক” — তা আমার বন্ধুমহলে ছেয়ে গেল। আমাদের বিভিন্ন আলোচনায় এ কথা ট্যাগলাইনের মতো ঘুরে ফিরে আসত। আমার কলেজবন্ধু এবং প্রাক্তন সহকর্মী শ্রেয়ণ আর আমি মিলে পরিকল্পনা করি সন্দীপদার আত্মজীবনী প্রকাশ করব। সে ইচ্ছা একদিন তাঁর কাছে গিয়ে প্রকাশ করলাম। ততদিনে উনি আত্মজীবনীর কাজ শুরু করে ফেলেছেন। তাও আমাদের কথা ফেলতে না পেরে একটি দুই ফর্মার বই করতে রাজি হলেন। কয়েক মাস পর হাতে লিখে পাঠালেন সেই পাণ্ডুলিপি। নাম দিলেন, ‘নষ্টলজিক’। সে বই ‘নিবিড়’ প্রকাশনা থেকে ছেপে বেরল ২০২২ সালের লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। সেখানে সন্দীপদা লিখলেন কলকাতার উত্তাল সত্তরের দশক নিয়ে। সে সময় দিন বদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে নকশালবাড়ি৷ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তরতাজা ছেলেমেয়েরা। কলকাতা শহর রক্তাক্ত। সীমান্তের ওপারে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর জেগে উঠল স্বাধীন জাতি — বাংলাদেশ। সারা ভারতে জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা। চারদিকে গণ-আন্দোলন। তারই প্রভাব নির্বাচনে পড়ল। পরাজিত হল ইন্দিরা গান্ধি সরকার। নতুন অকংগ্রেসি সরকারও নানা ঘাত-প্রতিঘাতে নড়বড়ে। এমন টালমাটাল সময়ে এক তরুণ রুখে দাঁড়াল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। লিটল ম্যাগাজিনের স্পর্ধা নিয়ে। যেন মুক্তির দশক খুঁজে নিল ভিন্নতর পথ। চেতনার মুক্তি। মননের মুক্তি। সেদিনের বিদ্রোহী যুবক কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন। সেদিনের সেই তরুণ হয়ে উঠলেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের কর্ণধার। তিনি সন্দীপ দত্ত।

এ লেখার শেষে দুটি কথা বলতে ইচ্ছা করছে। এক, টেমার লেন হয়ে উঠুক সন্দীপ দত্ত সরণি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জানুক তাঁর আন্দোলন ও অবদানের কথা। আর দুই, তাঁর হাতে গড়া স্বপ্নের ওই লাইব্রেরি যেন বন্ধ না হয়ে যায়। উত্তরসূরিরা সে দায়িত্ব নিক। এ দুটিই আমার ব্যক্তিগত অনুরোধ।
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
