শতাব্দীর বয়স তখন পাঁচ মাস ন’দিন। রাঁচি জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে আটটার সময় রক্তবমি করেছিল ঈশ্বর। তারপর ন’টায় ঈশ্বরের দেহে জড়িয়ে এল ঘুম। ঈশ্বরের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হবে, মৃত্যুর কারণ কলেরা। তারপর লেখা হবে, কলেরার কারণ অজানা। স্বেচ্ছা অনাহারের দায়কে ধামাচাপা দিতে দিতে জেলসুপার অ্যান্ডারসন বুঝবেন, উলগুলানের শেষ নাই। ঈশ্বর কখনও মরেনি, ঈশ্বররা কখনও মরে না।
“ক্ষমা করিস মা, আমায়। করমি মা আমার। তোর দুর্ভাগ্য, তুই পেটে মানুষের জন্ম দিয়েছিলি। এ জগতে মানুষ হয়ে বাঁচতে চাইলে বড়ো কষ্ট রে। আমি তোদের মানুষের মতো বাঁচতে দিতে চেয়েছিলাম। আমিই ওদের গর্ব করা শিখিয়েছিলাম। ওরা আমাকে ভগবান বানাল। আমার কী দোষ বল? মা রে, আজ যাওয়ার দিনে তোকে বড়ো দেখতে ইচ্ছা করছিল। এরা যেতে দেবে না, মা রে। আমার নশ্বর দেহকেও এদের ভয়। সেই ছোটবেলায় তুই যে পাথর মায়ের গল্প শোনাতি, আজ আবার তোর কোলটায় বসে সেই গল্পটা শুনতে ইচ্ছা করছে। তবে তোর কাছে হাতজোড় করছি, তুই যেন পাথরের সম হয়ে যাস না, মা। ভগবানের মাকে পাথর হতে নাই যে।”
চুটু আর নাগুর দেশ। আমরা নাম দিলাম ছোটনাগপুর। সেই চুটু আর নাগুর বংশধরদের মাথার উপর শহুরে আইনের প্যাঁচ। সেসবকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারও ছিল না। অতএব, ভিটেছাড়া। বাস্তুহারা। তারপর ভিক্ষাবৃত্তির আত্মঘাতী জীবন। কুরুমদা, বাম্বা, চালকাড়। সুগানা-করমির সংসারে সুখ আসছিল। ধীর পায়ে। চতুর্থ সন্তান আসার দিন বৃহস্পতিবার ছিল। তাই নামকরণ করতে বেগ পেতে হল না।
আরও পড়ুন : লাহোর, হিজলি, আজকের তালোজা: বন্দি মুক্তিসৈনিকের মৃত্যু এবং চরিত্রেরা
“ক্ষমা কোরো বাপ, আমায়। তুমি আমায় সকলের মতো হতে বলেছিলে। তোমার কথা রাখতে পারলাম না। আবা, চাইবাসা নিয়ে যাওয়ার জন্য তোমার কাছে জেদ করেছিলাম সেদিন। বুঝিনি, কোন আকর্ষণ আমাকে টানছিল। এখন বুঝছি, এই নির্মম পরিণতির প্রশান্তির আকর্ষণ আমি সেদিন থেকেই পেয়েছি। একটু, একটু, করে। আবা, তোমার ওই কুরুমদা, বাম্বা আর চালকাড়ের বাইরেও মস্ত একটা পৃথিবীর খোঁজ আমি তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি আজকে। সেদিন তোমার কথা শুনলে আজকে দিব্যি ‘আরান্দি’ করে বাচ্চা প্যায়দা নিয়ে চালাতে পারতাম ঠিকই, কিন্তু ও পৃথিবীর প্রতি টান আমার কোনওকালেই ছিল না। ভগবান হয়েছিলাম বলে তুমি গর্ব করতে, মা দুঃখ করত। মাকে দেখো আবা, মা’টা আমার বড় ছেলে-কাঙালি।”
বুরজুতে ‘দ্য গ্রেপ্স আর সাওয়ার’-এর গল্পে ইংরেজি হরফ শিখে নেওয়ার রূপকথা। তারপর সুগানার হাত ধরে চাইবাসার মিশন। ফাদার নট্রট। অমূল্য। ছাত্রাবাস। পড়াশোনা। গান। বাঁশি। ছোটনাগপুর টেনিওর অ্যাক্ট। সর্দারদেরকে অপমান নট্রটের। মুখের উপর প্রতিবাদের সাহস। অমূল্য আসতে দিতে চায়নি। হাত ছাড়তে চায়নি। কাঁদছিল খুব। তবু জাতির অপমানকে এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার ছেলে সুগানা মুন্ডার চতুর্থ সন্তান নয়।
“আমি মিশনের বিপক্ষে ছিলাম না। মিশনের জীবনকে আমি পৃথক করে দেখিনি কখনও। বুলি ফোটবার আগেই আমার নামের আগে বা পরে ডেভিড বসেছিল। ডেভিড, দাউদ, যাই বলে থাকো। মিশনের ফাদারকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। আমাদের সমাজে ইংরাজি বলতে পারেনি কেউ। আমি পেরেছিলাম। আমার দোভাষির দরকার পড়েনি। আমার মধ্যে সহজাত নেতা ছিল। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম। আমার মধ্যে তথাকথিত সভ্য সমাজের সমস্ত গুণই ছিল। খারাপ ব্যবহার করিনি কখনও, কারও সাথে। না, মুন্ডাদের সাথে, না দিকুদের সাথে। আমি শুধু অধিকার চেয়েছিলাম। ওদের দেখানো আইনের পথেই হাঁটতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম, সামান্য আর্জি ফাইল করতে গিয়েও সেখানে জুটছে অপমান। অতএব, উলগুলান। আমি কি সত্যিই অপরাধী?”
আদিম অরণ্যানী দেবীর কান্না তাকে শক্তি দিয়েছিল। অরণ্যের প্রতিটা কোণ যার চেনা, তাকে আটকাবে সভ্য সমাজের আইন? আমি, আমিই হব নেতা। দায়িত্ব নেওয়ার নেতৃত্ব দেব আমিই। সেই শুরু। তরুণ নেতৃত্বের বলিষ্ঠতার সামনে নতজানু হয়েছিল অরণ্যবাসীরা। কিন্তু খুশি হয়নি তার মা। নিষ্ঠুর দমননীতি বিপ্লবীকে নাশ করতে পারে না, পিঠের পেছনে গেঁথে যাওয়া বিশ্বাসহন্তা ছুরিও সেই গতি রোধ করতে অক্ষম, বিপ্লবীর পরাজয় কেবল একটিই জায়গায়। তার নিজের ঘরে।
“মাকে আমি কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আমার কাছে দুটো পথই খোলা ছিল। হয় দশ, নয় এক। আমার মাকে খুশি করতে গিয়ে আমি হাজার মায়ের কষ্ট দেখতে পারব না। হ্যাঁ, আমিই ধরতি-আবা। আমি জানতাম, কেন বসন্ত ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো। আমি জানতাম, কেন গাঁকে গাঁ কলেরায় উজাড় হয়ে যায়। মিশনে পড়াশোনা করা ছেলে আমি। আমার মধ্যে সত্যিকারের আলো ছিল। আমি সেই আলোই জ্বালাতে চেয়েছিলাম আগে। আমি বিগ্রহের ভগবান হতে চাইনি। এর মধ্যে থেকেই মিশনের প্রভাবমুক্ত একটা সমাজ গড়ার ডাক দিয়েছিলাম। তাই পুরনো রীতিনীতি ঝেড়ে ফেলে নতুন করে সমাজ গড়তে চাইছিলাম। সব কালেই শুদ্ধ জিনিস থাকে। প্রাচীনত্বের গরিমা আর আধুনিকতার আলো এই দুইকে মেশাতে চেয়েছিলাম আমি।”

মুন্ডা-অহঙ্কারের আলোয় ঝলসে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভিত। সিমলার লাটভবনে বসে গভর্নর জেনারেলের মনে হচ্ছে, এই বিদ্ঘুটে নামটাকে সরকারের ভয় কেন। মুন্ডারা স্বাধীন হচ্ছে। খাজনা। দেবে না। বেঠবেগারি। দেবে না। চাষ। করবে না। কমিশনার থেকে কনস্টেবলের চোখেমুখে বিস্ময়। ১৮৯৫। তুমি মুন্ডাদের খেপাচ্ছ? না, আমি খেপাইনি, কেবল ধর্মের কথা বলেছি। জেলে বসে কমিশনারের ইংরাজি প্রশ্নের জবাব ইংরাজিতে। মুখের উপর। কারাদণ্ড। দু’বছরের।
“হ্যাঁ, আমি ধর্মের কথাই বলেছিলাম ওদের। যে ধর্মে বিগ্রহপুজো নয়, স্বাধীনচেতনার প্রয়োজন। আমাদের হাজার বছরের অধিকার কেড়ে নেবে কেন বাইরের লোকে? হ্যাঁ, যদি ওরা আমার কথায় আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে পারে, তবে আমি ওদের ভগবান। যদি আমার কথায় ওদের মুন্ডা-গর্ব দর্পিত হয়, আমি ওদের ভগবান। বন্দি হয়ে আরও বেশি ভগবান হয়েছি আমি। ভগবানের বিচার করবে দিকুর উকিল? আমায় জেলে রাখো যতদিন খুশি। যত জেলে থাকব, তত দেখবে আমার ক্ষমতা। আমি প্রাচীন অরণ্য জননীর আশীর্বাদ পেয়েছি, আমার জন্মের দিন আকাশে তিন তারা দেখা যাওয়ার গল্প শুনেছি মায়ের কাছে, আমাকে আটকে রাখবে সেই জেল এখনও তৈরি করতে পারেনি দিকুরা। আমি ফিরবই।”
দু’বছর বাদে ফেরা। ১৮৯৭। ওই নভেম্বরেই। তার আগে ভাদোই ফসল জ্বলে গেছে, রবিশস্য ওঠেনি। ভগবান জেলে থাকার অসহায়তা লুকোতে পারে না। অলৌকিকতা সব মিথ্যে। কমিশনার বলে দিয়েছে, আর খেপালে কপালে দুঃখ আছে। কিন্তু এ কী আকালের পৃথিবীতে এসে পড়ল সে? অতএব, এবার ধর্ম আর বিপ্লব একসাথে। যে যোদ্ধা, সেই ধার্মিক। যে ধার্মিক, সেই বিপ্লবী। বিপ্লব। ওরা বলত উলগুলান।
“কমিশনারকে কথা দিয়ে এসেছিলাম আর হাঙ্গামা বাঁধাব না। কথা রেখেছি। ছুটকো হাঙ্গামা আর বাঁধাইনি। আমি সংগঠন গড়েছি। আগে নিজের ধর্মকে সকলের কাছে ছড়িয়ে দিতে নিযুক্ত করেছি প্রচারকদের। এ ধর্ম আমাদের সিঙবোঙার সনাতনী অন্তঃসারশূন্যতা নয়। এই ধর্মের নাম উলগুলান। এখানে আবেগ নেই, পিছুটান নেই, শুধু ঝাঁপিয়ে পড়া আছে, মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার দুঃসাহসিকতা আছে। সকলে মিলে এককাট্টা হওয়ার লড়াই। জমিদার, মহাজন, ব্রিটিশ, যারাই আমাদের ক্ষতি করেছে, তাদের এবার খেদাবার সময় এসে উপস্থিত। আমাদের অধিকার আমরা ছিনিয়ে নেবই। এ অরণ্য আমাদের আদিকাল থেকে লালন করেছে, তোমরা কেড়ে নেবার কে হে? উলগুলান, উলগুলান।”
পাথরের উপর মাটি। মাটির উপর উনুন। উনুনের আগুনে মাটি মুখ লুকোচ্ছে পাথরের নিচে। ভগবান সকলকে সহজ বিজ্ঞানটা বুঝিয়েছিল। মূর্খ মানুষগুলো জানল, এ ভগবানের খেলা। তবে ওরা জানল, পাথর আসলে ওরা নিজেই। আগুন একবার জ্বালাতে পারলে দিকুদের বন্দুক-গোলার প্রতিরোধ ঝুরঝুরে মাটির মতো এভাবেই মুখ লুকোবে। আহ, ভগবান, কত কী জানো তুমি! সুনারা বলছিল এসব।
“আমি ওদের বিজ্ঞানটা বোঝাতে চেয়েছিলাম। বোঝাতে পারিনি। তাতে অবশ্য ক্ষতি হয়নি। মানুষগুলো আমাকে বিশ্বাস করত অন্ধের মতো। রূপক অর্থটা বুঝিয়ে দিতেই কাজ হয়েছিল। ওরা বুঝেছিল, একটা আগুন জ্বালানো দরকার। আমি ওই আগুনের ফুলকিটাকে সযত্নে ফুঁ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র। বাকিটুকু নিজের মতোই জ্বলবে জানতাম। চুটিয়ার পিতৃ-পুরুষের মন্দির দখল করেছিলাম। দিকুদের বিগ্রহ যা ছিল, সব শেষ করে দিয়েছি। ভিন্ন মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে সত্যিই কি আমি অপরাধ করেছিলাম? এতটা কি না করলেও চলত? কিন্তু ওরা যদি আমাদের ধর্ম কেড়ে নেয়, অধিকার কেড়ে নেয়, ভুল বুঝিয়ে ক্রিশ্চান করে, তার যদি কোনও শাস্তি না হয়, তবে আমার মন্দিরথানের দখল নেওয়া অপরাধ হবে কেন?”
ডোম্বারি পাহাড়ের নিচে সেই সভা। ফেব্রুয়ারির ঠান্ডায় শীতবস্ত্র শুধু আগুনের তাপ। নগ্ন উর্ধ্বাঙ্গে লাগছে আগুনের ঝাঁঝ, বুকের ভেতর অগ্নিশিখার তাণ্ডব। সকলের একসাথে খাওয়ার অঙ্গীকার। ভগবান এরপর বলবে অনেক কিছু। আগামীদিন আসছে। হয় স্বাধীনতা, নয় ব্রিটিশের জেল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর যেটুকু পড়ে থাকে, সেটুকুই জ্বলছে সামনে, শুকনো কাঠ আর ঝরে যাওয়া পাতার প্রলেপ যাকে আরও বেশি দুর্নিবার করে তোলে।
“আমি দুটো পথ বাতলে ছিলাম। অহিংসার পথ। আর লড়াইয়ের পথ। জানতাম ওরা লড়াই ছাড়া অন্য পথে যেতে আর রাজি নয়। ততদিনে ক্ষুধার্ত বাঘের রক্তপিপাসা ওদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা ছড়িয়েছি আমিই। কিন্তু তাও আমি ওদের নেতা, ওদের ভগবান। ওদের সমস্তটা বুঝিয়ে মত চাওয়াটা আমার কর্তব্য-নীতির অনুসারী। শান্তির পথে চললে আর্জির পর আর্জি লেখা। আর আছে অনন্তকালের অপেক্ষা। তাতে আমাদের জীবনটা হয়ত বাঁচবে, কিন্তু ও বাঁচাকে যে বাঁচা বলে না, তা ওরা সবাই মানত। কিন্তু লড়াইয়ের পথে উত্তেজনা আছে। চটজলদি ফলাফলের উত্তেজনা। স্বাধীনতার নেশাতুর উত্তেজনা। অতএব, উলগুলান, উলগুলান।”
সরকারের খাতায় এক নতুন আইটের নাম যোগ হল। ভগবানের প্রথম নামের সাথে যুক্ত হয়ে। ১৮৯৯। বড়দিনের উৎসবে মত্ত সাহেব-মেমদের পার্টির ফোয়ারায় বিস্ফোরণ। খবরের। অগ্নিসংযোগ, তির ছোঁড়ার খবর। যিশুর জন্মদিনেই জন্ম নিল উলগুলান। দুজন নিহত। রেড অ্যালার্ট। হুলিয়া। চিরুনি তল্লাশি। এর মধ্যেই শুকনো নদীর খাতে কনস্টেবলদের ঘাড়ে বলোয়ার কোপ। গয়া মুন্ডা। গয়ার বাড়িতে খণ্ডযুদ্ধ। মেয়ে, বউ, বাচ্চা কেউ বাদ গেল না গ্রেপ্তারি থেকে।
আরও পড়ুন : সোভিয়েত রাশিয়ার সাড়া না পেয়ে জার্মানির সাহায্য নেন সুভাষচন্দ্র
“উলগুলানের দুই অধ্যায় থাকবে। আমিই বলেছিলাম। প্রথম পর্ব বড়োদিনে। আমাকে গাঁয়ে, জঙ্গলে কুকুরের মতো খুঁজেছে পুলিশ। আমি যে ভগবান। ভগবান কি ধরা দেয়! তারপর গয়ার বাড়িতে ওই কাণ্ড হল। গয়ার বউমাদেরকেও ছাড়েনি দিকু ডিসি। তবে একজন ছিলেন। দিকুরা তাকে নিজেদের সমাজে বলত কলঙ্ক। জেকব। জেকব সাহেব। আমাদের হয়ে কথা বলত চিরটাকাল। কেন বলত। গয়ার বাড়িতে ঘরসুদ্ধ লোকের মাথার উপর আগুন লাগিয়েছিল ডিসি। জেকব ওকে ছাড়েনি। জেকবকে ওরা জিততে দিল না। ওদের কাছে ন্যায়বিচারের দাম নেই। অন্তত মুন্ডাদের জন্য। কিন্তু ডিসি শুধু গয়াকে, ওর পরিবারকে আটকই করতে পারল, আসল ব্যাপার কিছুই জানল না। খুন্টি থানার দিকে এগোচ্ছিলাম আমরা। সেদিনই।”
রাঁচিতে মুন্ডা-আক্রমণের গুজবে পাহারা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রহসন। তারপর সৈলরাকাবের পাহাড়। পাহাড়ের গুহায় গুহায় সংসার। মেয়েদের পিঠে বাঁধা থাকত বাচ্চারা। স্ট্রিটফিল্ড, ফোর্বস, রোজ। খুন্টির পুলিশ, সাইকোর পুলিশ। বন্দুক, বেয়নেটের কেতাদুরস্ত সাজ। প্রথমে আত্মসমর্পণের হুংকার। কাজ হয়নি। তিনবার ব্ল্যাংক ফায়ার। তারপর… প্রথমে গুটুহাতুর মাঙ্গাল মুন্ডার বড় ছেলে হাথিরাম মুন্ডা, তারপর বরতোলির সিংরাই মুন্ডা, হাথিরামের ভাই হরি মুন্ডা, গৌরী মুন্ডা, পিঠে বাঁধা কচি ছেলেটাও…
“ক্ষমা কোরো তোমরা আমায়। আমি তোমাদের ভগবান। আমার কথাতেই এই জীবনপণ করেছ তোমরা। তবু আমিই ক্ষমা চাইছি তোমাদের কাছে। মাঙ্গাল মুন্ডা, ক্ষমা করে দিও আমায়। তোমার দুই ছেলেকে আমিই কেড়ে নিয়েছি। গৌরী, ক্ষমা করো। তোমার কচি ছেলেটার পিঠ ভেদ গুলিটা তোমার বুকে গিয়ে বিঁধল, আমি পাথরের আড়াল থেকে দেখা ছাড়া কিছু করতে পারলাম না। তবে মনে রেখো, তোমাদের রক্তকে ব্যর্থ হতে দেব না। তোমাদের নাম উচ্চারিত হবে এই অরণ্যের গাছের ঘষটানিতে, সৈলরাকাবের পাহাড়ের পাথরের খাঁজে খাঁজে। মা রে, আমি কি অপরাধ করেছি মা? করমি মা আমার, এতগুলা মানুষ আমার ডাকে পাহাড়ে এসে জীবন দিয়ে দিল, তাদের মরণের দায় কি আমারই, বল না মা!”
নারীহত্যায় শাস্তি নেই। কাগজে কাগজে সঠিক খবরের দায় নেই। জংলি জাতির বিচারালয় নেই। আছে শুধু নোটিশ। ভগবানকে এবার হাতেনাতে চাই। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। নির্বিচারে হত্যার মিছিল। পুরস্কার ঘোষণার কারসাজি। তবু ধরা পড়েনি ভগবান। সালি, পরমি, সুনারা, ডোনকারা সর্বক্ষণের সঙ্গী। পরমি ভাত রাঁধতে বসেছিল। ধোঁয়ার কুণ্ডলী। শশিভূষণ রাই। পাঁচশো টাকার টোপ। সলিটারি সেলের ঠিকানা। বিদায় অরণ্য। বিদায় চালকাড়।

“শশিভূষণকে ওরা মারতেই পারত। আমি বারণ করেছি। থাক, বড়োলোক হয়ে বেঁচে থাক। পরমিটা ভাত রাঁধছিল। পেটের জ্বালাকে নেভানোর ক্ষমতা আমার জানা নেই। তোর উপর রাগ নাই আমার। পারলে তুইও আমায় ক্ষমা করিস, পরমি। তোকে আরান্দি করতে চেয়ে বলেছিলাম, আমার সহকর্মী হতে হবে। তুই কনুকে ভালোবাসলি। আমি বেঁচে গেলাম যেন। তোর কপাল এমন মন্দ, কনুটাও আমার জন্য লড়তে এসে মরে গেল। সৈলরাকাবে সেদিন ওরও বুক ফুঁড়ে দিয়েছিল দিকুর গুলি। আজ তোদের সকলকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোরা এই আগুন নিভতে দিস না। অরণ্য মা আমার, তোকে শুদ্ধ দেখে যেতে পারলাম না মা। তোর আব্রু রক্ষা করতে পারলাম না। ক্ষমা করিস আমায়। দেখিস তোর সন্তানদের। দেখিস ওদের।”
শতাব্দীর বয়স তখন চুরানব্বই বছর পাঁচ মাস ন’দিন। ভগবানের রক্তবমির বয়স তখন চুরানব্বই। ভগবানের মৃত্যুর বয়স তখন চুরানব্বই। প্রাক-বর্ষার তাণ্ডব সেদিন দিনভর। বৃহস্পতিবারের বিকেলে ভূমিষ্ঠ শিশু; প্রাক-বর্ষা যাপনের রজত-জয়ন্তী পেরিয়ে আসছি আমি। ভগবান পঁচিশ দেখেননি। ভগবানেরও জন্ম হয়েছিল বৃহস্পতিবার। তাই বিরসা। বিরসা দাউদ নয়, বিরসা ডেভিড নয়, বিরসা মুন্ডাও নয়, ভগবান, বিরসা ভগবান।
সোহম দাস
