পৃথিবীর বুকে অমীমাংসিত রহস্যগুলির মধ্যে একটি ‘মেরি সেলেস্ট’ জাহাজকে ঘিরে! এই জাহাজটির প্রথম নাম ছিল ‘আমাজন’। ১৮৬০ সালের শেষের দিকে নোভা স্কোশিয়ার ‘বে অফ ফান্দি’-র পাড়ে স্পেনসার দ্বীপে এই জাহাজটি তৈরি করা হয়। পরবর্তীকালে এই জাহাজটি মার্কিন এক বণিকের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং তখন এর নতুন নাম রাখা হয় ‘মেরি সেলেস্ট’।
১৮৭২ সালের ৭ নভেম্বর ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ব্রিগস তাঁর স্ত্রী, সন্তান এবং ৭ জন নাবিককে নিয়ে নিউওয়র্ক থেকে জিনোয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ৫ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ব্রিগেন্টিন জাহাজ ‘দেই গ্রাটিয়া’ অ্যাজোর্স থেকে প্রায় ৪০০ মাইল পুব দিকে অবস্থান করছিল। সেই সময় জাহাজের নাবিকরা এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পান। সামান্য দূরে অন্য একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে যার ডেকে কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছে না। আবহাওয়া এমন খারাপ নয় যে জাহাজের নাবিকদের ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। গ্রাটিয়ার ক্যাপ্টেন ডেভিড মোরহাউস ব্যাপারটা ভালোভাবে লক্ষ করে অবাক হয়ে যান। জাহাজটা তার পরিচিত, মেরি সেলেস্ট। সেই জাহাজটি তার জাহাজ থেকে প্রায় আট দিন আগে নিউ ইয়র্ক বন্দর থেকেই ছেড়েছিল ইতালির জেনোয়ার উদ্দেশ্যে। এত দিনে মেরি সেলেস্টের ইতালির বন্দরে পৌঁছে যাবার কথা! সেখানে বন্দর থেকে এত দূরে উদ্দেশ্যহীনভাবে জাহাজটি ভাসতে দেখে ক্যাপ্টেনের মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। তাই দেরি না করে তিনি তৎক্ষণাৎ নিজের জাহাজের নাবিকদের নির্দেশ দেন মেরি সেলেস্টের কাছে জাহাজ নিয়ে যেতে।
আরো পড়ুন : লোচ নেস দানব কি স্কটিশ হাইল্যান্ডসে সত্যিই রয়েছে?
কাছাকাছি পৌঁছেও মেরি সেলেস্ট থেকে কোনোরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে ক্যাপ্টেন ডেভিড মোরহাউস উদ্ধারকারী নৌকা পাঠান সেখানে। কিন্তু মূল কারণ জানবার পর তিনি-সহ দেই গ্রাটিয়া জাহাজের সবাই হতবাক হয়ে যায়। মেরি সেলেস্ট কোনও ধরনের চালক ছাড়াই ভেসে বেড়াচ্ছে! কোনও রকমের আক্রমণ, মহামারি, দুর্ঘটনা – কিছুর চিহ্ন নেই জাহাজে। জাহাজ তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যান না নাবিক বা ক্যাপ্টেনের খোঁজ। জাহাজের বেশিরভাগ জিনিস একেবারে গোছগাছ করা অবস্থাতেই রয়েছে। জাহাজের লগবুকে শেষবারের মতো লেখা হয়েছে নভেম্বর ২৫ সকাল ৮ টায় অর্থাৎ শূন্য জাহাজ উদ্ধারের দশ দিন আগে। সেই সময় জাহাজটি অবস্থান করছিল সান্তামারিয়া থেকে ৬ মাইল উত্তর-পূর্ব কোণে। ক্যাপ্টেনের ঘরে পাওয়া যায় তার এবং তার স্ত্রীর পোশাক, বাচ্চার খেলনা আর বিছানার নিচে পাওয়া যায় খাপে ভরা একটি তলোয়ার। কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়া জাহাজ ছেড়ে সবাই কোথায় চলে গেল এর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না কোথাও।
কারও কারও মতে, নাবিকরা নেশাগ্রস্ত হয়ে ভেসে গিয়েছিলেন। আবার কারও মতে জলদস্যুদের হামলায় পড়েছিল মেরি। কেউ আবার খাড়া করেছেন সামুদ্রিক দানবের হামলার তত্ত্ব। তত্ত্বগুলির মধ্যে একটি বিস্ময়কর তত্ত্ব ছিল এই যে, জাহাজটিতে কোনও ভাবে মদ থেকে আগুন লেগে যায় এবং সেই ভয়ে সকলে পালিয়ে যান। কিন্তু এই ধারণাগুলোর সমর্থনে কোনও প্রমাণ কোনও দিনই সামনে আসেনি।
আরো পড়ুন : সন্তানের জন্ম দিতে গান উৎসর্গ করে হিম্বা জনজাতি
১৮৮৪ সালে কোনান ডয়েল এই জাহাজকে নিয়ে একটি ছোটোগল্প লেখার সময় কিছু নতুন তথ্য সামনে আনেন। কিন্তু সেগুলিও প্রামাণ্য হিসাবে স্বীকৃত হয়নি। ২০০২ সালে, তথ্যচিত্রকার অ্যানি ম্যাকগ্রিগর তাঁর তথ্যচিত্রের জন্য নতুন ভাবে তদন্ত শুরু করে নতুন কিছু তথ্য আবিষ্কার করেন। ম্যাকগ্রিগর দাবি করেন, ক্যাপ্টেনের কাছে ভুল ক্রোনোমিটার ছিল এবং গন্তব্য থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পশ্চিমে ছিল মেরি। এ ছাড়া জাহাজের পাইপ আটকে জল জমে জাহাজটি ডুবে যাওয়ার ভয়ে তাঁরা সকলে জাহাজ ছেড়ে চলে যান। ম্যাকগ্রিগরের এই তত্ত্বকে সঠিক হিসেবে না ধরা গেলেও তাঁর তত্ত্ব তুলনামূলক ভাবে অন্যান্য তত্ত্বগুলির থেকে গ্রহণযোগ্য ছিল কারণ তাঁর কাছে প্রমাণ হিসাবে নষ্ট হয়ে যাওয়া পাইপটি ছিল। পরবর্তীতে এই ভূতুড়ে জাহাজ নিয়ে জেন ইয়েলনের ‘দি মেরি সেলেস্ট- অ্যান আনসল্ভদ মিস্ট্রি ফ্রম হিস্ট্রি’ বই এবং ‘দি ট্রু স্টোরি অফ দি মেরি সেলেস্ট (২০০৭)’ এবং ‘ফ্যানটম শিপ’ (১৯৩৫) সিনেমাও তৈরি হয়।
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
Image by Matthew Z. from Pixabay

