এই মহৎ নেশা নিয়েও এমনকি, লোকে যা-তা বলে বেড়াত! ভানুর কাছে একবার একজন এসে বলেছে – “জানলেন, জহরের বাড়িতে অনেক বই দেখলাম। আসলে ওসব বুজরুকি, পড়াশোনা মোটেই করে না”। ভানুর তৎক্ষণাৎ চাবুক – “হ্যাঁ, আমি কিন্তু আমার সব বইতে মলাট দিয়ে রেখেছি, পাছে জহরের কাছে গিয়ে আবার না বলেন, ভানুটা কিসসু পড়াশোনা করে না!”
(গতকালের পর)
১৯৭২-এ জন্ডিসে আক্রান্ত হলেন (পলিডরের পক্ষ থেকে প্রশান্ত সেইসময়েই গিয়েছিলেন)। তখন থেকেই শরীরে থাবা বসাতে আরম্ভ করেছে জীর্ণতা। তাও তার মধ্যেই কমিক স্কেচ করছেন, থিয়েটার করছেন, সিনেমা করছেন। জন্ডিসটা বারবার ফিরে ফিরে আসছিল। এর মধ্যেই একটা বড়োসড়ো ব্লান্ডার করে ফেললেন ছবি প্রোডিউস করতে গিয়ে! প্রযোজনা-মস্তিষ্ক তাঁর সত্যিই ছিল না, সেটা বোঝেননি! বাজারে ধার হয়ে গেল পঁচাত্তর হাজার টাকা! সত্তরের দশকে অনেক! ব্যস, টাকা শোধ করতে ফাংশানের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন! বিশ্রামের দরকার ছিল সেখানে, সেখানে শরীরে ধকল কয়েকগুণ বেড়ে গেল! আর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ল মদ্যপানের মাত্রা! লিভার নষ্ট হতে শুরু করেছে! সহশিল্পীদের অনেকের সাথেও তখন মনোমালিন্য শুরু হয়েছে! অজিত চট্টোপাধ্যায় তখন জহরের ব্যবহারে বেশ দুঃখিত, জহর তাঁকে রংমহলের থিয়েটারে ভালো পার্ট দিচ্ছেন না! রবি বসু একথা জহরকে বলতেই জহর বললেন, তিনি নিজেও সেটা বুঝতে পারছেন! অজিতের ফ্লেক্সিবিলিটি অনেকটাই নষ্ট হয়েছে কিন্তু সেটা মুখ ফুটে তাঁকে বলতেও পারছেন না! অজিতকে এমন প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, “যদি অন্য কোথাও ভালো রোল পাস তো সেখানে চলে যাস, আমি কিছু মনে করব না!” কিন্তু অজিত যাবেনইনা কিছুতেই!
চূড়ান্ত অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছেন জহর! সরযূ দেবীর সাথেও সম্পর্ক খারাপ করে ফেলেছেন, অন্যান্যদের কথায় বিশ্বাস করে! সরযূকে রংমহলের দায়িত্ব থেকে সরাতে চাইছিল সেইসব মন্ত্রণাদায়ীরা। কিন্তু সরযূ দায়িত্ব কিছুতেই ছাড়লেন না! হলে যাওয়া অবশ্য বন্ধ করেছিলেন! যাইহোক, অবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সরযূ দেবীর কাছে ক্ষমা চাইতে তাঁর শ্যামাদাস রোডের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন! সরযূ দেবীর কোলে মাথা রেখে “তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও বড়োমা” বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিশুমনের জহর!
আরো পড়ুন : জহর রায় কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন নরেশ মিত্রের সামনে
মঞ্চেও তখন এমন এক্সটেম্পো করছেন ডায়লগের, বাকিরা আর সেরকম সুযোগই পাচ্ছে না নিজেদের অভিনয়ের! চূড়ান্ত সমালোচনা সইতে হচ্ছে চারিদিকে, রবি বসু নিজেও লিখেছিলেন – “শোচনীয় পরিণতি!” দুঃখ পেয়েছিলেন জহর! আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছিলেন কি? হতে পারে! শেষের দিকের সিনেমাগুলো যেমন ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’, ‘অগ্নীশ্বর’, ‘ব্রজবুলি’, ‘সেই চোখ’, এগুলোতে মাত্রই কয়েক মিনিটের রোল করেছেন, আর সেরকম কাজ দিতে চাইত না কেউ! একসময়কার নাদুসনুদুস চেহারাটা শুকিয়ে আধখানা, গাল ভেঙে গেছে, কঙ্কালসার-জহর রায়কে দেখলে দর্শক তখন আর হাসিতে ফেটে পড়ে না!

১লা আগস্ট, ১৯৭৭। সকালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে একটা ফোন এল – “মেডিক্যাল কলেজে জহরদা মারা গেছেন। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটু খবর দিতে পারেন?” সৌমিত্র ফোন করেন ভানুকে। তারপর দু’জনে মেডিক্যালে এসে দেখেন, আর কেউই নেই, মেসের লোকজন জিনিসপত্র কিনতে গেছে, তারাই রাত্রে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন জহরকে। সৌমিত্র আর ভানু ওপরে উঠে গিয়ে দেখেন, একটা সবুজ কাপড় ঢাকা দিয়ে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন জহর! ভানু দাঁড়াতে পারছিলেন না সোজা হয়ে! তাঁর নিজেরও তখন শরীরের অবস্থা ভালো নয়, কয়েকবছরের অতিরিক্ত ধকলে হার্টের রোগ দেখা দিয়েছে, তার ওপর এমন একখানা মেন্টাল শক! শুধু উচ্চারণ করেছিলেন – “জহরের কি দেশের কাছে এইটুকুই পাওনা ছিল সৌমিত্র? অন্য দেশ হলে স্যার উপাধি পেত!”
সব্যসাচীর স্মৃতি বলে – “পরের দিন সকালে ভানুকাকু বাড়িতে এসে কাঁদতে-কাঁদতে আমাদের দরজার সামনেই বসে পড়লেন!” ভানু থাকতে পারেননি! তাঁর শরীরের কথা ভেবে সরযূ দেবীই বাকিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যেতে, কারণ সত্যিই ভানুকে সেদিন সামলানো যাচ্ছিল না! পরে আকাশবাণীতে জহরের স্মৃতি-অনুষ্ঠানেও নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি, কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন, কোনওরকমে অনুষ্ঠান শেষ করেন! শোকমিছিলে সুচিত্রা সেন জহরের মরদেহের কপালে চুম্বন করে বলেছিলেন – “তুমি চলে গেলে, চার্লি?” নাঃ, চার্লি নন, জহর রায়ই চলে গেলেন! আটান্নও পূর্ণ হয়নি, জহর রায় কোনওদিন বুড়ো হলেন না! আর কী আশ্চর্য, জহর যার ভাবশিষ্য ছিলেন, সেই চার্লিও চলে গেলেন সেই বছরেই, বড়োদিনে!
আরো পড়ুন : জহরের স্ত্রীকে দেখে মজা করলেন উত্তম কুমার
সূর্য সেন স্ট্রিটের দু’পারের রাস্তা। একটা দিক ঢুকে যাচ্ছে রাধানাথ মল্লিক লেন, শ্রী গোপাল মল্লিক লেনের দিকে! সেই রাস্তা ধরে সোজা গিয়ে বাঁদিকে ঘুরলেই একটা বাড়ি, তবে নম্বর ভাগ করা। লোহার দরজার ২১ নম্বর। তারই গায়ে কাঠের দরজার ওপরে লেখা ২১/১। পায়রাদের বকবকম, পাশেই একটা কলোনি থেকে আসা নিত্যদিনের চিৎকার, বাড়ির মুখোমুখি ক্লাবে ছেলে-ছোকরাদের আড্ডার আওয়াজ – সবের মাঝে বাড়িটাকে ঘিরে কোনও স্মৃতিমেদুরতা খুঁজতে যাওয়াটাই বোকামি! কর্তা চলে গেছেন আজ চার দশক। পাড়ারও বেশির ভাগ মানুষ বোধহয় জানেনও না, বাংলা সিনেমার কিংবদন্তীর বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাদেরই আসা-যাওয়ার পথে!
জহর সত্যিই চলে গেছেন জন মানসের অনেক আড়ালে! অমিয় নিবাসে তাঁর লাইব্রেরিও আর নেই! দুটো ঘরই ছেড়ে দিয়েছিলেন কমলা। ওই বিপুল বইয়ের সম্ভার বেশির ভাগই দিয়ে দিয়েছিলেন বিভিন্ন লাইব্রেরিতে, সুবর্ণরেখা প্রকাশনীকে, চেনা জানা আরও অনেককেই! রাধানাথ মল্লিক লেন যাওয়ার রাস্তার অপর পারেই সূর্য সেন স্ট্রিটের আরেকটা দিকের রাস্তা ঢুকে যাচ্ছে যেদিকে, সেদিকেই! গলির মুখেই ছিল জহরের মেস। সেখানে ঝুলছে সাইনবোর্ড, লাল ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা অক্ষরে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে – ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) শিয়ালদহ পশ্চিম আঞ্চলিক কমিটি’। তলায় জ্বলজ্বল করছে ঠিকানাটা – ৭১/১এ, পটুয়াটোলা লেন, কলকাতা-৭০০০০৯।
তথ্যসূত্র :
বসু, রবি; ১৯৯৮। ‘সাতরঙ: স্মৃতির সরণিতে বাংলা চলচ্চিত্রের অর্ধ শতাব্দী’, দে’জ পাবলিশিং।
রায়, সত্যজিৎ; ১৯৭৯। ‘একেই বলে শুটিং’, নিউস্ক্রিপ্ট।
চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ (সম্পাদিত); ২০১১। ‘হাসি-রাজ ভানু-জহর’, পাণ্ডুলিপি।
দাস, সোহম; ২০১৫। ‘বিষণ্ণ সেই জোকার’, মাস্তুল, সপ্তম সংখ্যা।
ভট্টাচার্য, সোমেশ; ২০১৮। ‘অ্যাই, সত্যজিতের আলজিভ দেখবি?’, আনন্দবাজার পত্রিকা।
বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানু; ২০০৮। ‘লেখালেখি’, আজকাল, দ্বিতীয় সংস্করণ।
চক্রবর্তী, রথীনকুমার; চক্রবর্তী, রাজীব; রায়, জয়ন্ত; মুখোপাধ্যায়, রঞ্জন; মণ্ডল, রাজীব; ব্যানার্জী, শুভঙ্কর ও চক্রবর্ত্তী, শুভাশিস (সম্পাদিত); ২০১৭। ‘চৌরঙ্গী’ – ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ সংখ্যা, দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ।
চৌধুরী, সুস্নাত; ২০১৫। ‘বাংলা আমার’, আনন্দবাজার পত্রিকা।
নচিকেতা ঘোষ(সংকলন); ২০০৯। আজকাল।
(সমাপ্ত)
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
