বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও জহর বেশির ভাগ সময়েই কলকাতা আর পাটনায় কাটানোর ফলে বাঙাল ভাষাটা অতটা বলতে পারতেন না। অনেকেই ঠাট্টা করত এ নিয়ে! জহরের সাফ উত্তর ছিল – “সেটা একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে রে। আমি গড়গড়িয়ে বাঙাল ভাষা বলতে পারলে ভানুর ভাত মারা যেত। ওকে আর করে খেতে হতনা”। এমন অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের ব্র্যাকেটটা, ভেঙে গেল, হঠাৎই!
(গতকালের পর)
পেশাদারি জগতের বাইরের জগতটায় তাঁর প্রিয় মানুষদের মধ্যে ভানু যেমন ছিলেন, তেমনই তাঁর পরিবারও-স্ত্রী কমলা, তিন মেয়ে সর্বাণী, ইন্দ্রাণী, কল্যাণী আর ছেলে সব্যসাচী। কমলার সাথে জহরের বিয়ে হয়েছিল ১৯৫০-এর ২৮শে জানুয়ারি! প্রথমে পাটনাতেই থাকতেন কমলা একা! তারপর কলকাতায় জহর বাড়ি করলে সপরিবারে চলে আসেন ২১/১ রাধানাথ মল্লিক লেনে। পরিবার-অন্ত প্রাণ ছিলেন খুব। একটা রাতও পরিবারকে ছেড়ে থাকতে চাইতেন না! তমলুকের সেই অনুষ্ঠান মাঝরাত্রে শেষ হতেই জহর রবির কাছে আবদার করতে থাকেন, দু’টোয় একটা হাওড়াগামী লোকাল আছে, ওটায় তাঁকে তুলে দেওয়া হোক! কমলা আর ছেলেমেয়ের জন্য মনখারাপ করছে!
আবার প্রশান্ত ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জানা যায়, একবার পাটনার বেঙ্গলি ক্লাব থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জহরকে! শহরের কৃতী সন্তান বলে কথা! হঠাৎ যাওয়ার আগে এক মেয়ের ভাইরাল ফিভার দেখা দিল! জ্বর কমছে না কিছুতেই! জহর রায় সাথে সাথে অনুষ্ঠানে যাওয়া বাতিল করে দিলেন! তাও প্রশান্তরা চাইছিলেন, যাতে অনুষ্ঠানটা কোনোরকমভাবে করে আসতে পারেন! জহর প্রশান্তকে বলেছিলেন – “বাবা তো হওনি। হলে বুঝবে সন্তান কী জিনিস!” সব্যসাচী ছিলেন সবার ছোটো! শিশুবেলায় তাঁকে ওড়িয়া গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন জহর! ওড়িয়া গানগুলো শিখেছিলেন অমিয় নিবাসেরই ওড়িয়া কর্মচারীদের কাছে!
আরো পড়ুন : জহর রায় সিনেমার মতো ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন আনন্দময়
এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথাও এখানে বলতে হয়, যে তিনি ওড়িয়া, হিন্দি এসব ভাষা এত ভালো জানতেন ও দক্ষতার সাথে বলতেন, যে, অনেকেই তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছে বোম্বে চলে যাওয়ার জন্য! জহর রাজি হননি! কেরিয়ারের একদম শুরুর দিকে নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় বিমল রায়ের ‘প্যাহলা আদমি’ (১৯৪৮) ছাড়া আর কোনও হিন্দি ছবি করেননি! নেতাজি ও আইএনএর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা ওই ছবিতেই প্রথম কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে নচিকেতা ঘোষের, তিনি তখন মেডিকেল কলেজে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র! নচিকেতার গাওয়া গানটিতে লিপ দিয়েছিলেন জহরই, বাঙালি সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন! হিন্দি অভিনয় তো আমরা দেখেছি ‘ছদ্মবেশী’তেও! মোসাহেবলালের সেই “আরে ছো ছো ছো, কেয়া শরম কী বাত”-এর চিত্রায়ণে শরীর দুলিয়ে নাচ কি দর্শক আজও ভুলতে পেরেছে? হিন্দি উচ্চারণেও কোনও জড়তা নেই, পরিষ্কার অবাঙালি উচ্চারণে হিন্দি বলছেন! চূড়ান্ত সফল হতেনই হয়ত! তাও যাননি, ওই পরিবারের কথা ভেবেই! এমনকি কাজের সাথে পরিবারের মধ্যেকার দূরত্বটাকেও বজায় রেখেছেন আজীবন!
ছেলেমেয়েদের নিয়ে প্রায়ই খেতে যেতেন এসপ্ল্যানেডের চাংওয়া, বেড়াতেও নিয়ে যেতেন অনেক জায়গায়! কিন্তু সিনেমা বা নাটকের পরিসরে সেরকম ভাবে তাদের আসতে দেননি! অফিসঘরও করেছিলেন পাশের পাড়ায় পটুয়াটোলা লেনে! সামান্যই দূরত্ব, সেই অর্থে দেখতে গেলে, কিন্তু ওইটুকুই যথেষ্ট! স্ত্রীকে নিয়ে একবারই একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। মিনার্ভা থিয়েটারে শিল্পী সংসদের পক্ষ থেকে অভিনয় হচ্ছিল ‘চরিত্রহীন’-এর। সেখানেও আবার একটা মজার ঘটনা ঘটে গেল! উত্তমকুমারও গিয়েছেন সেখানে। বসেছেন পাশাপাশিই! উত্তম কমলাকে প্রথমবার দেখে জহরের উদ্দেশ্যে একটু লেগপুলিং করার চেষ্টা করলেন-“জহরদা, সেই যে কার গলায় যেন মুক্তোর মালা”। জহর লজ্জা পেয়েছিলেন, কিন্তু সিরিয়াসলি নেওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই! জহর-সুলভ ভাবেই উত্তরটা ফেরত দিলেন – “তুই যার কথা বলছিস সে তো তোরই পূর্বপুরুষ রে! তবে তার সঙ্গে আমার একটু তফাৎ আছে। তুই যার কথা বলছিস সে হনুমান। আর আমি হনু Man. সে সীতারামের ভক্ত, আর আমি Rosa Rum-এরভক্ত। তফাৎটা বুঝলি?” উত্তম তো হেসেই খুন, সাথে ‘জহরদা’র তারিফ না করেও পারলেন না! কমলা দারুণ রান্না করতেন! তাঁর হাতের বাঙাল রান্নার বড় ভক্ত ছিলেন ভানু, সুচিত্রা সেনরা! এবং খাদ্যরসিক জহর নিজে তো বটেই! মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সাথেও একদম দাদা আর ছোটবোনের সম্পর্ক ছিল জহরের! মাধবী জহরকে বলতেন ‘গুরু’, আর জহর তাঁকে বলতেন ‘চ্যালা’!

আর ছিল তাঁর অমিয় নিবাসের দুটো ঘর, তাঁর জীবনের অনেকটা জুড়েই। কাজ না থাকলে সারাদিন প্রায় সেখানেই। সেখানেও তাঁর ‘বন্ধু’, অজস্র! তবে রক্তমাংসের বন্ধু নয়, বরং তার চেয়েও আরও বেশি কিছু! বারোটা আলমারি ঠাসা কয়েক হাজার বই! সংগ্রহে ছিল মারি সিটনের ‘আইজেনস্টাইন’, হ্যারল্ড ডাউন্সের ‘থিয়েটার অ্যান্ড স্টেজ’, জর্জ হেনরি লিউইসের ‘অন অ্যাক্টরস অ্যান্ড দ্য আর্ট অফ অ্যাক্টিং’, এরল্ড ফ্লিনের ‘মাই উইকেড উইকেড ওয়েজ’, জন অসবর্নের ‘ইনঅ্যাডমিসিবল এভিডেন্স’, চার্লস ডারউইনের ‘দ্য ভয়েজ অফ দ্য বিগল’, সমারসেট মমের ‘গ্রেটেস্ট শর্ট স্টোরিজ’, অ্যালফ্রেড হিচকক সম্পাদিত ‘সিক্সটিন স্কেলিটন ফ্রম মাই ক্লোজেট’, কনস্ট্যান্টিন স্তানিস্লাভস্কির ‘মাই লাইফ ইন আর্ট’, শেক্সপিয়রের একাধিক সংস্করণ, চার্লি চ্যাপলিনের বই, নিউ ইংলিশ ড্রামাটিস্ট সিরিজ, আরও কত কী! রোমান, আফ্রিকান, চাইনিজ মাইথলজি-সেসব নিয়েই একটা গোটা আলমারি! বাংলা বই তো ছিলই! হিন্দিসাহিত্যের প্রেমচাঁদ, কিষেণচাঁদও পড়তেন, অনুবাদে নয়, হিন্দিতেই!
আরো পড়ুন : জহর রায় কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন নরেশ মিত্রের সামনে
তবে বই কাউকেই পড়ার জন্য ধার দিতেন না! ঘরের মেঝেতে বিছানা পাতা ছিল, সেখানে বালিশে ঠেস দিয়ে বই পড়তেন! এই বইয়ের নেশাটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন নাট্য-ব্যক্তিত্ব অহীন্দ্র চৌধুরি। জহর যাকে বলতেন অহীনবাবা। অহীন্দ্র চৌধুরি নিজেও প্রচুর বই পড়তেন, তাঁরও বাড়িতে নিজস্ব লাইব্রেরি ছিল! তিনি বলেছিলেন – “জহর, বই পড়ো, বই পড়ো। যে লাইনে এসেছ সেখানে পৃথিবীর অন্য দরজাগুলো তোমার জন্য বন্ধ। কিন্তু বই পড়া তো তোমার কেউ আটকাতে পারবে না। বই পড়তে পড়তে দেখবে পৃথিবীর অন্য সব দরজাগুলো তোমার সামনে খুলে গেছে”।
অর্থাভাবে ফর্মাল এডুকেশন হয়নি, সেটাকে পুষিয়ে নিয়েছিলেন সেলফ-এডুকেশনে! ‘সুবর্ণরেখা’ প্রকাশনীর ইন্দ্রনাথ মজুমদার, যিনি জহরের মৃত্যুর পরে তাঁর সংগ্রহের আড়াই হাজার বই কিনে নিয়েছিলেন ১৯৯৬ সালে, তিনি বলেছেন – “১৯৫০ থেকে ৭০-এই কুড়ি বছরে কলকাতায় যত ভালো বই এসেছে তার প্রায় সবই ছিল জহরবাবুর সংগ্রহে”। বইপাড়ার একদম গায়েই লাইব্রেরি, ফলে ইচ্ছে হলেই কিনে আনার বাড়তি সুবিধা! বইপড়ার পাশাপাশি বইয়ের গন্ধ শোঁকারও একটা নেশা ছিল তাঁর। রবি বসুর লেখা থেকেই জানা যায়, লোকজনের সাথে কথা বলতে বলতেও বইয়ে নাক গুঁজে গন্ধ শুঁকে নিতেন! এই মহৎ নেশা নিয়েও এমনকি, লোকে যা-তা বলে বেড়াত! ভানুর কাছে একবার একজন এসে বলেছে – “জানলেন, জহরের বাড়িতে অনেক বই দেখলাম। আসলে ওসব বুজরুকি, পড়াশোনা মোটেই করে না”। ভানুর তৎক্ষণাৎ চাবুক – “হ্যাঁ, আমি কিন্তু আমার সব বইতে মলাট দিয়ে রেখেছি, পাছে জহরের কাছে গিয়ে আবার না বলেন, ভানুটা কিসসু পড়াশোনা করে না!”
(আবার আগামীকাল…)
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
