সত্যজিতের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাও ছিল তাঁর! সত্যজিৎ তাঁর থেকে বছর দুয়েকের ছোটো হলেও তাঁকে ডাকতেন ‘মানিকদা’ বলে! সত্যজিৎ এর কারণ জানতে চাইলে উত্তর দিয়েছিলেন – “আমি আপনার চেয়ে এজে বড়, কিন্তু আপনি যে ইমেজে বড়ো”! আহা, কী অসাধারণ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ!
(গতকালের পর)
তবে এমন পানিং আর কথার পিঠে কথা তৈরিতে এককথায় রাজা ছিলেন জহর রায়! যেমন একবার উৎপল চক্রবর্তীকে সমরেশ বসু সম্পর্কে বলেছিলেন, সমরেশ বসুকে তিনি নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি কালকূট না পানকূট! এত পান করেন কেন?” বোঝো, অথচ প্রশ্নকর্তা নিজেই কিনা নিয়মিত মদ্যপান করতেন, শেষ বয়সে ধারদেনায় ডুবে যে পানের মাত্রা লাগামছাড়া হারে বেড়ে গিয়েছিল! উৎপল একবার সরকারি কাজে মালদা যাওয়ার সময় ট্রেনে জহরের স্যুটকেস দেখে তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্টকে বলেন, একদিন দেখা করা যায় কিনা! উৎপলকে শিবরাম চক্রবর্তী, ভানু-জহরকে দিয়ে হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন করানো যায় কিনা, এ নিয়ে ভেবে দেখতে বলেছিলেন! সেটা আর হয়নি, হলে বাংলার দর্শক এক অনন্য সৃষ্টি দেখতে পেত, সন্দেহ নেই!
উৎপলের সাথে জহরের ওই একবারই দেখা হয়েছিল, সেবার মালদাতেই! জহরের শরীরে তখন ভাঙন ধরেছে, বিশ্রামের উদ্দেশ্যেই আসা মালদায়! উৎপল শরীরের হাল কেমন জানতে চাওয়ায় উত্তর – “আগে রক্ত নোনতা ছিল। এখন মিষ্টি হয়ে গেছে। সুগার!” নিজের অসুখ নিয়েও মজা! ব্যক্তিজীবনে যেমন ছাপ রেখে গিয়েছেন সকলের মনে, আর অভিনয়-জীবনে তো সেকথা আর বলার অপেক্ষাই রাখে না! তাঁর ওই গোলগাল চেহারায় হেসে হেসে মিষ্টি করে বলা কথা, অভিনয়ের গুণে মজাদার করে তোলা, এসব তো যারা দেখেছেন তাঁর সিনেমা, সকলেই জানেন!

কিন্তু তার বাইরেও জহর যে আরেকটি জিনিস খুব দক্ষতার সাথে করতেন, সেটি হচ্ছে ওই পানিং এবং ডায়লগ-ইম্প্রোভাইজেশন! স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে নিজের ইচ্ছেমত ডায়লগ জুড়ে দেওয়া আর তাঁর ওই কিংবদন্তিতুল্য পানিং এসব জহর করতেন প্রায় প্রতি সিনেমাতেই, এবং বলাই বাহুল্য, এত নিখুঁত আর উপভোগ্য হত, যে পরিচালকরাও তাঁকে সেই স্বাধীনতা দিয়ে দিতেন। আরও যেটা আশ্চর্য লাগে শুনলে, সেটা হচ্ছে তিনি কিন্তু এই জিনিস প্রথম সিনেমা ‘পূর্বরাগ’ থেকেই করে আসছেন! পূর্বরাগের জন্য অর্ধেন্দুর কাছে যখন অভিনয়ের টেস্ট দিতে চান জহর, ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটরে’-র একটি সিন পুরো অবিকল অভিনয় করে দেখান, এবং এটা দেখে অর্ধেন্দু নতুন করে শুধু জহরের জন্য এরকম একটা সিন রাখেন সিনেমাতে! এই সিনেমায় জহরের একটি বিখ্যাত ডায়লগ ছিল – “ফুর ফুর করে একটা নারকেল গাছ আকাশের দিকে উঠে গেছে!” ফুর ফুর করে হাওয়া বইছে একথা শুনেছি আমরা, কিন্তু ফুর ফুর করে নারকেল গাছ ওপর দিকে উঠে গেছে, এমন অদ্ভুত কথা কি শুনেছে কেউ কখনও? কিন্তু ওটাই যে জহর, প্রথম সিনেমাতেই নিজের তৈরি ডায়লগে মাত করে দিচ্ছেন দর্শকদের, বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি লম্বা, অনেক লম্বা রেসের ঘোড়া!
‘ধন্যি মেয়ে’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘অগ্নীশ্বর’, জহরের এইসব সিনেমার পরিচালক অরবিন্দ মুখার্জি তো বলেইছিলেন – “ও কোনোদিন বাঁধাধরা সংলাপে নিজেকে ধরে রাখতে পারত না। হয়ত কয়েক মিনিটের সংলাপ, ও বানিয়ে আরও কয়েক মিনিট বলে দিল”। জহর অবশ্য রবি বসুকে বলেছিলেন, এই এক্সটেম্পোর অভ্যাসটা তাঁর হয়েছিল অত অত ফাংশান করে করে! তবে এই অতিরিক্ত ডায়লগ বলার ফলে অনেকসময়েই তাঁর সহ-অভিনেতাদের যে অসুবিধায় পড়তে হয়, মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়, একথাও স্বীকার করতেন জহর, কিন্তু এই অভ্যাস (বা বদভ্যাস) থেকে কোনোদিনই বেরোতে পারেননি!
আরো পড়ুন : জহর রায় কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন নরেশ মিত্রের সামনে
জহরের অভিনয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি গুণ ছিল, কিংবা হয়ত দোষও বলা যেতে পারে, সেটি হচ্ছে, রোল ছোটো না বড়, সেই নিয়ে কোনও বাছবিচার করতেন না! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এই কারণে সময়ে সময়ে বকুনি খেতেন! কিন্তু যে যা রোল দেবেন, সে যত কম টাকাই হোক, জহর রায় কোনও ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে করে দেবেন! সেকারণেই হয়ত ‘পরিচালক চতুর্ভুজ’-এর (সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ) সাথে তো বটেই, একইসাথে অর্ধেন্দু মুখার্জি, বিমল রায়, নির্মল দে, অরবিন্দ মুখার্জি, অগ্রদূত, তরুণ মজুমদার, দীনেন গুপ্ত, হরিদাস ভট্টাচার্য্যদের সাথেও কাজ করেছেন সমানতালে! আর অভিনয়ের কথা এলে অবধারিতভাবে তো আসবেই ভানুর সাথে প্রায় তিরিশ বছরের পার্টনারশিপ! প্রথমদিকে এই দুজনকেই পরিচালকরা ব্যবহার করেছেন শুধুমাত্র কমিক রিলিফ হিসেবে, যেখানে-সেখানে গুঁজে দিয়ে! ভানু যথেষ্ট দুঃখের সাথে লিখেছেন – “কোনও একটা দৃশ্যে হয়ত ৬০টা শট, তার মধ্যে ৫৮টাতেই নায়ক-নায়িকা, বাকি দুটিতে আমরা। এর মধ্যেই যা কিছু করে দিতে হয়েছে। অন্য অভিনেতাদের তুলে ধরার একটা প্রচেষ্টা থাকে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই হয়নি। হয়ত নায়ক-নায়িকা কথা বলছেন, ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, আমাদের তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। গত পনেরো-বিশ বছর ধরেই আমাদের শুনতে হচ্ছে, ‘একটা কিছু করে নাও ভাই, দর্শক যাতে হাসে’। বাংলা ছবির এটাই হচ্ছে দেউলেপনা – একটা হাসির পরিস্থিতি সৃষ্টি করবার ক্ষমতাও সকলে হারিয়ে বসেছেন”।
সত্যিই কিন্তু মানুষকে নির্ভেজাল হাসি উপহার দেওয়াটাই কঠিন সব কাজের মধ্যে একটা, ভানুর মতে – “সিরিয়াস অ্যাক্টিংয়ে একটু বেশি কাঁদলে ক্ষতি নেই, কম কাঁদলেও চলবে। কিন্তু কমিক অ্যাক্টিংয়ে প্রোপোরশন জ্ঞানটা ভীষণ প্রয়োজন। তাই খুব ভাল সিরিয়াস অ্যাক্টর না হলে ভালো কমেডিয়ান হওয়া যায় না”। সেই কাজটাই তিন দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে করে গেছেন দুজনে! ভানু-জহররা এ নিয়ে যাই অভিমান-অভিযোগ করুন, আমাদের কিন্তু সত্যিই কিন্তু কোনও অভিযোগ নেই, অন্তত তাঁদের অভিনয় নিয়ে! এ ব্যাপারে কিন্তু আমরা সকলেই একমত, যে অনেক, অনেক সিনেমায় আমরা, যারা সত্যিই হাসতে ভালোবাসি, তারা কিন্তু নায়ক-নায়িকার থেকে ভানু-জহরকে বেশি করে দেখব বলে বসে থেকেই, কখন এই দুজন সিনে আসবেন!
যেমন, উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম ছবি ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। উত্তম-সুচিত্রা জুটির ছবি মানেই আদ্যন্ত প্রেমের ছবি, এই ধারণাটা কিন্তু পরে হয়েছে, সাড়ে চুয়াত্তরের ক্ষেত্রে এটা পুরোপুরি একেবারেই বলা যাবে না! বরং এটাকে পুরোপুরি কমেডি বলতে চাইলে অনেকেই মত দিয়ে দেবেন, যদিও সেটাও পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত হবে না! রামপ্রীতি-রমলার (উত্তম-সুচিত্রা) ঝগড়া, তারপর লুকিয়ে দেখা করা, চিঠি চালাচালি এসবকে ছাপিয়েও সিনেমাতে কিন্তু অনেক বেশি আমরা উপভোগ করেছি ডিগডিগে রোগা কেদারের (ভানু) সব ব্যাপারে চালিয়াতি, লম্ফঝম্প, রোগা চেহারা নিয়েও বুক ফুলিয়ে এগিয়ে যাওয়া, বিচিত্র মজাদার সুরে বাঙাল ভাষায় সব এক-একটা অবিস্মরণীয় ডায়লগ-থ্রো আর হঠযোগী গোলগাল কামাখ্যার (জহর) ওই কাঁচা টমেটো খাওয়া, রমলাকে ঝাড়ি মারতে যাওয়া কেদারের উদ্দেশ্যে কামাখ্যা আর প্রাণকেষ্টর (অজিত চট্টোপাধ্যায়) বিচিত্র উচ্চমার্গীয় সুরে গাওয়া “কেদার আমার, একবার নেমে আয়, নেমে আয়, ও বাপ কেদার, একবার নেমে আয় নেমে আয়”, কেদারের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে রামপ্রীতি-রমলার পিছু নিতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পা ছড়ে ফেলা, সাথে বোর্ডিং ম্যানেজার রজনীবাবুর ভূমিকায় তুলসী চক্রবর্তী আর তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করা মলিনা দেবীর দাম্পত্য কলহের নিখুঁত অভিনয়, ‘মুখসর্বস্ব’ প্রাণকেষ্ট, দেনায় জর্জরিত জুয়া আর মদপ্রিয় জয়নারায়ণ (শ্যাম লাহা), টিপিক্যাল পিত্তি-জ্বালানো বয়স্ক শিববাবু (হরিধন মুখোপাধ্যায়), কথায় কথায় ‘ব্যোম কালী’ বলা কালীভক্ত অখিলবাবু (ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য) এদের সকলের যোগ্য সঙ্গত!
‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’-এও যেমন, অঞ্জন-নুপূরের (শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়-লিলি চক্রবর্তী) ওই ঢাক ঢাক গুড় গুড় প্রেমের মধ্যেও প্রচুর হাস্যরস পেলেও ওঁরাই কিন্তু আসল নায়ক! গোয়েন্দা মানে নিজেকে প্রচণ্ড সিরিয়াস উত্থাপন করে ভানু এত নিখুঁতভাবে হাস্যকর করছেন পুরো ব্যাপারটাকে, কাগজওয়ালা, টেলিফোন কোথাওই টাকা না দেওয়ায় সব পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এটাতেও কী সাবলীল হাসাচ্ছেন দুজনে। জহর জিজ্ঞাসা করছেন – “ফোন করতে বলছিস, কানেকশন আছে?”, উত্তরে ভানু বলছেন – “আজ পর্যন্ত আছে, কাল কেটে দেবে!” এমন অম্লানবদনে বলছেন, যেন কিছু ব্যাপারই নয়! বাড়িওয়ালা দশ মাসের ভাড়া চাইতে এলে টেবিলের তলায় সেঁধিয়ে যাচ্ছেন, তারপর ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে দিয়ে তাকে ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, নুপূরকে দেখে ধরার বদলে জহরের ‘কাম সেপ্টেম্বরে’-র মিউজিক মনে পড়ে যাচ্ছে, কবেকার একখানা হাড় জিরজিরে ভিনটেজ গাড়ি, না ঠেললে চলে না-যেমন সিনেমার গতি, তেমন পাল্লা দিয়ে হাসিয়ে যাচ্ছেন দুজনে! সত্যি, ওই কমিক-রিলিফের জায়গা থেকে নিজেদের জায়গাটা কিন্তু তাঁরা নিজেদের প্রতিভার জোরেই আদায় করে নিয়েছিলেন!
আরো পড়ুন : জহর রায় মঞ্চের ওপর বিপদে ফেললেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে
যেসব সিনেমায় তাঁরা নায়ক, সেখানে তো দর্শক আর কাউকে দেখবেই না বলতে গেলে! কিন্তু যেখানে চরিত্রাভিনেতা, সেখানেও দর্শক অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকবে ভানুর বাচনভঙ্গি, এক্সপ্রেশন আর জহরের স্ল্যাপস্টিক আর পানিংয়ের দিকে, সে তাঁরা তিন কি তিরিশ মিনিটই থাকুন সিনেমায়! আর সেইকারণেই বোধহয় দুজনেই লাভ করেছেন এক বিরল সম্মান, তাঁদের নিজেদের নামে তৈরি হয়েছে সিনেমা! একটায় শুধু ভানুর নাম (‘ভানু পেলো লটারী’, ১৯৫৮), একটায় শুধু জহর (‘এ জহর সে জহর নয়’, ১৯৫৯) আর একটায় দু’জনেরই নাম (‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ১৯৭১)। বাংলা সিনেমাতে তো নয়ই, সার্বিকভাবে ভারতীয় সিনেমাতেও এই সম্মান বোধহয় কারোরই জোটেনি! হলিউড বা ব্রিটিশ ফিল্মেও এমন উদাহরণ বিরল! চার্লি চ্যাপলিন, বাস্টার কিটন, স্ট্যান লরেন, অলিভার হার্ডি? আমাদেরও ভানু-জহর ছিলেন! তুলসী লাহিড়ী, তুলসী চক্রবর্তী, কুমার মিত্র, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়রা ধারাটা শুরু করেছিলেন, ভানু-জহর জমিটা শক্ত করেছিলেন, আর পরে সেই পূর্ণতাটা দারুণ সফলভাবে দান করেছেন অনুপ কুমার, রবি ঘোষ, চিন্ময় রায়রা!
কিন্তু ওই ‘কমেডিয়ান’ ট্যাগলাইনটা এত ট্যাজেডি নিয়ে আসে শিল্পীর জীবনে, সেটা পৃথিবীর সকল সফল কমেডিয়ানরাই বুঝেছেন! চার্লি যেসময় থেকে ওই ট্র্যাম্পকে সরিয়ে অন্যান্য চরিত্র করা শুরু করলেন, সেইসময় থেকেই জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়া শুরু! কাজ আগের মতই পারফেক্ট, ডিটেলিং, অভিনয়, সব আগের মতই আছে, কিন্তু হাসির পরিমাণ যেই কমছে, অমনি দর্শক আর নিতে পারছে না! এই একইভাবে ভুগতে হয়েছে আরও অনেককেই! তাছাড়াও আমরা এঁদের কমিক অ্যাক্টিং দেখতে পছন্দ করলেও খুব সম্মান কিন্তু এঁদের দিইনি! মানে আমাদের দেশে কমেডিয়ানদের কাজটাকে ‘লোক-হাসানো’ বলে যে তাচ্ছিল্যটা করা হয়, সেটা করতে গিয়ে আমরা ভুলেই যাই, যে এই হিউমার আনাটাই কতটা কঠিন! ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তো চিরকালই স্পষ্টবক্তা, কোনও প্রিয়-অপ্রিয় ধার ধারতেন না, এক সাক্ষাৎকারে শ্লেষের সাথে বলেইছিলেন – “আমাদের দেশে সবচাইতে ভালোবাসে কাঁদতে। হাত-পা ছড়িয়ে বসে এত আরাম করে কাঁদতে বাঙালির মত কেউ ভালবাসে না। …আবার কিছু লোক আছে দেখবেন যারা সবসময়ই চুপ করে থাকে, গম্ভীর কথা হলেও চুপ করে থাকে। উনি উচ্চমার্গে বিচরণ করেন, এটা প্রমাণ করার একটা প্রসপেন্সিটি। আসলে কিছুই ঢোকে না তার মাথায়। এছাড়া আছে আধা-আঁতেল, এটা আরও ভয়াবহ”।
সেই কারণেই এঁরা বারবার চেয়েছেন নিজেদেরকে ভাঙতে, দর্শক কীভাবে নেবে সেকথা তো সবসময় মাথায় রাখা যায় না! ভানু বলতেন – “আই অ্যাম স্টিল আফটার আ রোল!” কিন্তু ভার্সেটেইলিটিকে দর্শক সাময়িক উপেক্ষা করতে পারে, চিরকাল নয়! তাই এঁদের শুধুমাত্র অল-টাইম গ্রেট কমেডিয়ান না বলে অল-টাইম গ্রেট অ্যাক্টর বলাটাই বোধহয় বিবেচ্য হবে! জহরের কথায় ফেরা যাক! যেমন যাত্রিকের (তরুণ মজুমদার, শচীন মুখার্জি আর দিলীপ মুখার্জির ত্রয়ী) পরিচালনায় ‘পলাতক’-এর জহর! নীলকান্ত বৈরাগী আয়ুর্বেদ চিকিৎসক, অথচ সন্ধের পর যাত্রার রিহার্সাল দেয়! তরুণ মজুমদার বলেছিলেন – “এক কবিরাজ, কিন্তু অসম্ভব যাত্রা পাগল, সন্ধের পর রোগী দেখে না, রিহার্সাল করে। ওর মেয়ের বিয়ে হয় বাউন্ডুলে এক ছেলের সঙ্গে। এতে ওর ইন্ধন ছিল। বিয়ের রাতে সে উধাও। মেয়েটা চুপ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে জহরদা পিছন থেকে ঘরে ঢুকে পড়লেন কিছু একটা খোঁজার অছিলায়। বাবার অসহায় অবস্থা, তাঁর অপরাধবোধ এত সুন্দর ফুটিয়ে তুললেন! এটাই আসল জহর রায়!’’

‘পলাতক’-এর বাবা-মেয়ের জুটি বিজয় বসু পরিচালিত ‘বাঘিনী’-তেও! জহর রায় আর সন্ধ্যা রায়! মাত্র দশ মিনিট থাকলেন সিনেমাতে! চোলাইয়ের কারবারি বঙ্কা বা বাঁকা, সর্বক্ষণ পুলিশের নজরকে তোয়াক্কা না করে চোলাই বানিয়ে যাওয়া অপরাধী, চারদিন বাদে বাড়ি ফিরে এসে মা-মরা মেয়ের সাথে অশান্তি করে, আবার মেয়েটার দুঃখে নিজের কাজে অনুতপ্ত বাবা কিছুক্ষণ পরেই ধার করে চাল-ডাল-তেল-নুন আর মেয়ের মান ভাঙাতে শাড়ি কিনে নিয়ে আসে, মেয়ে যখন বলে কেন ধার করে আনতে গেলে, তখন বুক চিতিয়ে বলে – “আমার মেয়ের জন্য আমি কাপড় আনব, আমি যেভাবে ইচ্ছে আনব, তোর কী?”, তারপরেই পায়ে মরচে-ধরা পেরেক বিঁধে টিটেনাস হয়ে মরে যায় – ওই কয়েকটা মাত্র মিনিটেই চিনিয়ে দিচ্ছেন জাত! কিংবা ‘নিশিপদ্মে’র মদ্যপ নটবর, যে কিনা ফুচকাতেও তেঁতুল জলের বদলে কালী মার্কা ব্র্যান্ডের বাংলা মদ ঢেলে খায়, তারপর পয়সা না থাকায় ফুচকাওয়ালাকে ‘কালীমার্কা’ বোতল ধরিয়ে দেয় জোর করে! এই সিনেমাতেই সেই জনপ্রিয় গান “না না না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাব না”-র চিত্রায়ণে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় অনঙ্গর ভূমিকায় অভিনয় করা উত্তরকুমারের সাথে নাচ!
‘অগ্নীশ্বর’এর বুকিং ক্লার্ক, যে প্রথমে ডাক্তার ষোলো টাকা ভিজিট নিচ্ছে দেখে ডাক্তারের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে হাতে টাকা ধরিয়ে দেয়, বিরক্তির সাথে ডাক্তারকে চেয়ার এগিয়ে দেয়! তারপর ডাক্তার যখন ওই ষোলো টাকা ভিজিটের পুরোটাই তার বিছানায় ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন ওই আকুল ভাবে “ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু” করে ছুটে যাওয়া জহর! সত্যিই যেন কোনও ডাক্তার তাঁর ভিজিটের সবটাই ফেলে দিয়ে চলে যাচ্ছেন তাঁর বাড়িতে, এমনই বাস্তবসম্মত সেই অভিনয়! সেই বুকিং ক্লার্কই ডাক্তারের চওড়া হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে হয়ে উঠছে তার শুভাকাঙ্ক্ষী! ডাক্তারকে যারা সরাবার ফন্দি আঁটছে, তাদের কাছে ডাক্তারকে ভালোমানুষ বলতে সে এতটুকু পিছপা হচ্ছে না, তারা তার থেকে উচ্চপদে থাকা সত্ত্বেও, ডাক্তারকে চুপিচুপি জানিয়ে যাচ্ছে, ওইসব দুর্নীতিপরায়ণ লোকগুলো কী ধরনের কুৎসা রটাচ্ছে ডাক্তারের নামে! মাত্র কয়েকটাই সিন, তাতেই আলাদা করে ছাপ রেখে যাওয়ার মুন্সিয়ানা!
(আবার আগামীকাল…)
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
