তখন দার্জিলিঙে পড়াই। সেদিন দুপুরে কী কাজে যেন বাড়ি এসেছি। বাড়ি মানে ভাড়াবাড়ি পাহাড়ের কোলে। একদিকে একটা মেয়েদের নামি স্কুল অন্যদিকে হ্যাপি ভ্যালি চা বাগান। সে সময় দার্জিলিং কেন, কলকাতাতেও বুঝি সামান্য কিছু বাড়িতে এসেছে সাদা-কালো টিভি। রঙিন টিভি তো কল্পনায়। সারাদিন টিভিও চলে না। ভরসা এক ভাঙ্গা রেডিও কারও কারও। আমাদের তাও নেই। সালটা ১৯৮৪। শীতের শুরু। খবর দিল প্রতিবেশী এক মহিলা। ভয়ংকর খবর। তখন দুপুর, চারদিক সুনসান। এরপরই নেমে আসি সমতলের কলেজে (বারাসাত সরকারি মহাবিদ্যালয়) সরকারি আদেশে।
সেদিন ভদ্রমহিলা চোখে জল নিয়েই বললেন, জানেন, ইন্দিরা গান্ধি খুন হয়েছেন। জানলাম এবং বিশ্বাস করতে কষ্ট হল খুব। পরে দেখেশুনে বুঝেছি আসল কষ্ট ওদের হয়েছে। ওরা মাথাতে আর পাগড়ি বাঁধতে পারে না ক’দিন। গুরুদোয়ারা যেতে পারেনা। বন্ধ সে সবই। অথচ ওর নাকি স্বাধীন দেশের নাগরিক। পরে আরও যা শুনেছি তা হল: দিল্লি আর পাটনায় এবং আরও কিছু জায়গায় পাঞ্জাবিদের দেখলেই কোতল করা হচ্ছে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন টাইটলার নামে একজন ও আরও কিছু কংগ্রেসি নেতা। সবই শোনা কথা। দুঃখ হয়েছে সকলেরই, তা বলে এমন করে ওদের সংহার করা উচিত কি? এই মানুষগুলো একবার ভারতভাগের মূল্য দিয়েছে, তাতেও রক্তপাত থামেনি। মা আরও রক্ত চান বুঝি? সে প্রশ্ন কাকে করি, কাকে বলি, কে শোনে? গোধরা কাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছে সংখ্যালঘুরা, সেদিনও ইন্দিরাজির মৃত্যুর পর প্রাণ যায় যাদের তাঁরা সংখালঘুই। পার্থক্য আছে অবশ্যই। রাজধর্মের পরিপন্থী এমন হত্যাকাণ্ডে গোধরা কাণ্ডের মতো সরকারি সমর্থন জোটেনি। সে কি আমাদের ভাগ্য? কে জানে!
আরো পড়ুন : মরিচঝাঁপি – খরচের খাতায় থাকা মানুষেরা
মানুষ অবশ্যই সেদিন দুঃখ পেয়েছিল। দেখেছি সেদিন বাগানগুলি যেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ হয়ে যায়। যার অর্থ – গরিব খেটে খাওয়া মানুষও কষ্ট পেয়েছেন! কিন্তু তারা কেন কষ্ট পেল? ক’দিন আগেই তো স্বৈরাচারী এই মানুষটির দিকে ঘৃণা ছড়িয়েছিল মানুষ। জরুরি অবস্থা। ভুলি কী করে? তবে, এও সত্য যে বাংলার মানুষ জরুরি অবস্থায় তেমন বিপদে পড়ে নি। যদিও বরুণ সেনগুপ্তের মতো সাংবাদিককে কারারুদ্ধ করা হয়, কিছু পত্রিকার ওপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়্গ, তবু বলব তেমন কিছু হয়নি। এই কথা বলছি সে আমলে নকশাল করার অপরাধে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বা পরে বাম আমলে যেভাবে মরিচঝাঁপিতে বা নন্দীগ্রামে পুলিসি অত্যাচার দেখেছি তার সঙ্গে তুলনা করে।
জরুরি অবস্থার আগেই বাংলাদেশ যুদ্ধে জয় এসেছে তাঁর নেতৃত্বে। ৭৭-এর নির্বাচনে গো-হারা হেরেও তিনি ফিরে এসেছেন ক্ষমতায়।
সেই নেত্রীকে হত্যা করা হয়েছে নাকি স্বর্ণমন্দিরে সেই ঘৃণ্য অভিযানের জন্য (ব্লু স্টার), জরুরি অবস্থার অত্যাচারের জন্য নয়। বাংলাদেশ ও তার মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বকে চকিত করেছিল নিশ্চয়, তবু কে ভুলতে পারে, সেদিন এই দেশ ও তার নেত্রী যদি সেই সংগ্রাম ও বাংলাদেশের পাশে না থাকত!
আরো পড়ুন : ফিরে দেখা: সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস
তাঁর নিজ দেহরক্ষীর গুলিতে লুটিয়ে পড়ল সেদিন এমন মহান নেত্রীর দেহ। মানতেই হবে যে, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছিলেন নেত্রী ঐ ‘অপারেশন ব্লুস্টার’ করে। প্রমাণ হল যে রাজনীতিতে কোনও ভুলই শেষ পর্যন্ত ক্ষমা পায় না। এই সাধারণ সত্য কী ভুলেছেন আজ যারা তখতে আসীন? হয়তো।
মনে পড়ছে খুশবন্তের লেখাও। ভদ্রলোক ইন্দিরা গান্ধিকে পছন্দ করতেন না। স্বীকার করতেন না তাঁকে এশিয়ার মুক্তিসূর্য বলে। সেই তিনিই লেখাতে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন তাঁর সম্মোহনী শক্তির কথা।স্বীকার করেছেন বিদেশে দেশের সুনাম বৃদ্ধিতে তাঁর অবদানের কথা। না, আজও খুশবন্তের সঙ্গে তুলনীয় কোনও সাংবাদিক কলম ধরেননি বিদেশে দেশের সুনাম বৃদ্ধিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্বের কথা শোনাতে।
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
