“উফফ! আমি আর পারছি না। প্লিজ, লিভ মি অ্যালোন!” খুবই ক্ষীণ স্বরে ও বলল।
স্কোর বোর্ডে তখন রান ছিল আশিতে ছয়। জেতার জন্য প্রয়োজন ছিল আর মাত্র পঞ্চাশ রান। অফ স্টাম্পের বলটা কাট করে মারতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গেল ও। টাইমিং মিস হতেই বলটা ব্যাটের লোয়ার এজ নিল এবং তারপর সোজা মিডল স্টাম্পে। বিপক্ষ টিমের হুল্লোড় তখন সা-রে-গা ছেড়ে এক্কেবারে নি-তে পৌঁছেছে। ওরাও ভালোমতো জানে যে লিকুকে কম রানে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠানো মানে ম্যাচ পকেটে করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া। তবে সহখেলোয়াড়দের কাছ থেকে এমন টিটকিরি আশা করেনি ও।
প্যাভিলিয়নে ফেরার পরই কোচ বাঁটুলদা এমনভাবে ওর দিকে তাকাল, যেন পেলে ওর কিডনি ছিঁড়ে কুকুরকে খাইয়ে দেয়। পুটাই আর ছিটে টুপিতে মুখ ঢেকে মুখ নামিয়ে বসেছিল। ওরা ওপেনার। ওরা জানে, ওদের আরো কিছুক্ষণ ক্রিজে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু পারেনি। কোনওদিন পারেও না। তাই বোধহয় লজ্জায় মাথা নামিয়ে বসে আছে ওরা।

আরো পড়ুন : গুলঞ্চ গাছের নিচে, পর্ব – ১, উল্টোদিকের ছাদে
টুডু আর বিহান আউট হয়ে ফিরে এসে ডাগ আউটে বসে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে। পিকলু, টুবাই আর ঋককে খুশি খুশি দেখাচ্ছে খুব। মাঝেমধ্যে লিকুর মনে হয় যে, এইসব ছেলেদের কাছে দল খুব একটা বড়ো নয়। স্বার্থই বড়ো। দ্বিপ্রদা খুব ঠিক কথাই লিখেছে। যদিও প্রেমে দাগা খেয়ে, তবুও কথাটা বড্ড সত্যি –
“লজিক না ভেবে তুমি থেকে গেলে পারতে,
মানুষকে চেনা যায় শুধু তার স্বার্থে।”
আরও কিছুক্ষণ পর যখন স্কোর একশোতে আট, ঋকও গোল্ডেন ডাক হয়ে ফিরছে, তখন সবাই ওকেই দায়ী করতে লাগল। ঝুরো ঝুরো কাঁচের মতো টিপ্পনী ধেয়ে এল ওর দিকে। “ওর আর একটু ধৈর্য ধরে খেলা উচিত ছিল”, “ও এক্কেবারে ক্যালাস!” ইত্যাদি, প্রভৃতি। বাঁটুলদা তো একসময় রেগেমেগে বলেই ফেলল, পরেরবার লিকুকে ছাড়াই টিম বানাবে।
ওরা নামকরা একটা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। গত তিনবছর ধরে ওরা এই অঞ্চলের ইন্টারস্কুল ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ন। প্রতিবার ওইই প্রত্যেকটা ম্যাচে একটা করে হাফসেঞ্চুরি মেরে এই ম্যাদামারা দলকে জিতিয়ে এসেছে। নিয়মিত উইকেট-টেকারও ওইই। নিজের কাঁধে পুরো টিমকে টেনে নিয়ে এসেছে ও এতদিন। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে গেছে প্রতিটা মুহূর্ত। গত কয়েকদিনের চাঁদিফাটা গরমের মধ্যেও। আর আজ একটা ম্যাচের ফলাফলের ভিত্তিতেই সেই লিকুকে ছাড়া টিম? ভাবা যায়!
আজও তার ব্যতিক্রম হত না, যদি না গতকাল ওই ঘটনাটার মুখোমুখি হতে হত ওকে। ঝুরো ঝুরো কাঁচগুলোর সামনে খুব অসহায় বোধ করল ও। একটা একটা করে কাচের কুচি ওর বুকে এসে বিঁধছে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে ওর ছোট্ট বুকটা। সবার মধ্যে থেকেও আজ খুব একা বোধ হল ওর। ওর বুকের মধ্যে কোথা থেকে একটা শীতার্ত শহরের গোটা রাতটাই এসে ঢুকে পড়ল যেন। কে যেন ওর গলার ভেতর অবশ করার ওষুধ ঢেলে দিয়েছে অনেকটা।
“ম্যাচটা শালা তোর জন্য হারলাম,” পিকলু দাঁত কিড়মিড় করে বলল। “তুই যদি বোকার মতো ওই শটটা না নিতিস, তাহলে এবারও ট্রফিটা আমরাই পেতাম।” ঋক আর টুবাইয়ের বক্তব্যও সেম। তাহলে কি সত্যিই ও অবিবেচক? সত্যিই কি ওর সিলেকশনে ভুল ছিল? মা-ও তাই হয়তো একই কথাই বলে। বলে, “গর্দভ একটা!”
মিন্টের একটা হালকা গন্ধ পেল ও। এই গন্ধটা ওর খুব কাছের ছিল। অত্যন্ত কাছের ছিল। কিন্তু, গতকাল সন্ধের পর থেকে ওই গন্ধটা নাকে এলেই ওর সারা শরীর জ্বালা জ্বালা করছে। নাহ! আর ও নিতে পারছে না। ও সেখান থেকে উঠে স্কুলবাসের দিকে পা বাড়াল।
“দেয়ার ইজ ট্রায়ামফ অ্যান্ড ডিফিট ইন এভরি গেম। তোমরা হেরেছ, ওরা জিতেছে। এবং যোগ্য টিম হিসেবেই জিতেছে। তাও তোমরা একা ওকেই ব্লেম করছ কেন? অ্যান্ড ইউ বাঁটুল স্যার, ইয়েস ইউ, ইউ আর সাপোর্টিং দেম সাইলেন্টলি! দশজন মিলে একশো কুড়ি রান তুলতে পারল না, আর সব দোষ একা ওই বাচ্চাটার? হাউ ইনকরিজিবল! উফফ!”
ইরাবতী সান্যাল। লিকুদের ইরা ম্যাম। ইতিহাসের শিক্ষিকা। টেন্টে ঢুকেই তিনি নিজের চোখে যা দেখেছেন এবং নিজের কানে যা শুনেছেন, তাতে ওনার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলছিল। কথাগুলো বলার পর উনি নিজেকে সংযত রাখতেই বুঝি বা টেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন। মানুষ বোধহয় এরকমই হয়। নিজের দোষকে অন্যের ঘাড়ে কীভাবে ঝেড়ে ফেলতে হয়, তা এই বুদ্ধিমান প্রাণীরা বেশ ভালো করে জানে। এরা জানে, কীভাবে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেকে সেফ রাখা যায়।
আরো পড়ুন : গুলঞ্চ গাছের নিচে, পর্ব – ২, ওড়না
“অসহ্য!” আরেকবার রাগে বিড়বিড় করে বললেন উনি। তারপর স্কুলবাসে স্কুল ক্যাপ্টেনের জন্য বরাদ্দ সিটে বসে থাকা লিকুকে দেখে, সেইদিকে এগিয়ে গেলেন।
আবার মিন্টের হালকা গন্ধটা পাচ্ছে ও। যেখানেই যাচ্ছে, গন্ধটা যেন ওকে ফলো করে চলেছে। মনে হচ্ছে, ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যেন পৃথিবীময় বিষ ছড়িয়ে রেখে গেছে কেউ। আচ্ছা, ওকে কি কেউ একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না? মিন্টের গন্ধটা থেকে ওকে দূরে চলে যেতে দেবে না কেউ?
গতকাল সন্ধেয় টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। নিম্নচাপের শেষদিকের বৃষ্টি। চলে যাওয়ার আগে নিজের সবটুকু যেন উজাড় করে দিয়ে যেতে চাইছিল বৃষ্টিটা। ওর কাছে ছাতা ছিল না। টিউশনের শেষে ও ঝিম্পাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, ওর কাছ থেকে ছাতাটা চেয়ে নিয়েছিল। ফেরার সময় ওই একই মিন্টের হালকা গন্ধটা পেয়েছিল ও। ওই গন্ধটা ওকে গলিটার ভিতর টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ও-ও এগিয়ে গিয়েছিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো। বিনের তাল যেমন সাপকে নাচায়, ঠিক তেমনই। গলিটার ভিতরে বাঁদিকে ঘুরেই ও অবাক হয়ে থমকে গিয়েছিল!
মায়াময়, হলুদ আলোয় দু’টো আধভেজা শরীর অল্প বৃষ্টির মধ্যে পরস্পরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল। লালসা খুঁজে নিয়েছিল ঠোঁট। আর…
“নাহ! আর এসব ভাববে না ও। কে যেন ওকে ওর পা ধরে অন্ধকারের তলানিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ও উঠে আসার চেষ্টা করেও উঠে আসতে পারছে না। ওর বুকের ভিতর যেন অনেকগুলো ইগল নখ বসাচ্ছে পরপর। ও আর পারছে না। সত্যিই পারছে না!
এই মফসসলের এই ল্যাবিরিন্থ থেকে ওকে কি তাহলে উদ্ধার করবে না কেউ?
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
Sports player photo created by rawpixel.com – www.freepik.com
