পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘যোগবিয়োগ’ সিনেমার শ্যুটিং চলছে। ছবি বিশ্বাস, সুপ্রভা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি দৃশ্যের শ্যুটিং সেদিন। এদিকে একজন অভিনেতা ডুব মেরেছেন। তার বেশি সিন নেই। কিন্তু এই দৃশ্যে তিনি না থাকলে দৃশ্যটাই হবে না। সেদিনের শ্যুটিং বন্ধ হওয়ার মুখে।
তাহলে গুচ্ছের টাকাও নষ্ট। দুশ্চিন্তার মধ্যেই উপায় খুঁজে পেলেন অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়। সহকারী পরিচালকটিকেই নামিয়ে দিলেন। এর আগে কোনোদিনও ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেনি সে। কিন্তু, সেদিন প্রথম সুযোগেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল ছেলেটা। উল্টোদিকে ছবি বিশ্বাস, তাতেও ঘাবড়ানোর কোনো ব্যাপারই নেই। বরং, তাঁর অভিনয় দেখে চমকে গেলেন ছবি বিশ্বাস স্বয়ং। কোনোরকম তালিম ছাড়াই প্রথম সুযোগে এমন স্বতস্ফূর্ত অভিনয় করা যায়! অবিশ্বাস্য!
আরো পড়ুন : সুচিত্রা সেনের প্রয়াণে মালা সিনহার স্মৃতিচারণ
অনিল চট্টোপাধ্যায় প্রবাসী বাঙালি ছিলেন। দিল্লিতে বড়ো হয়েছেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। মাত্র এগারো বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন। সিনিয়র কেমব্রিজে উত্তর ভারতের মধ্যে প্রথম। সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক। জার্মান কোলাবরেশনের একটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মাস গেলে সাত-আটশো টাকা বেতন। পঞ্চাশের দশকে টাকাটা কম তো নয়ই, বরং বেশ বেশিই। কিন্তু চাকরি করার পাত্র তিনি নন। তখন একটাই ধ্যানজ্ঞান – অভিনয়। একদিন কী মনে হল, চাকরি ছেড়ে দিলেন। এদিকে আজ চাকরি ছাড়লে, কাল কী হবে ঠিক নেই। চিত্রপরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সহকারী হিসেবে যোগ দিলেন। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়, কালাচাঁদদা। মাইনে পঞ্চাশ টাকা।তাতে অবশ্য কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না তাঁর। একদিন কালাচাঁদদা বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা যদি সিনেমায় না আসে, কী করে চলবে!’’
সিনেমাকে ভালোবেসে নিজেকে ঢেলে দিয়েছেন নানা চরিত্রে। টাকাপয়সা-গাড়ি-বাড়ির ধার ধারেননি বিশেষ। অভিনয়ে তখন কতই বা রোজগার! ফলে, রেডিও ঘোষকের পদে চাকরির জন্য পরীক্ষায় বসলেন। পরীক্ষায় প্রথম হলেন তিনি, দ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এদিকে একজনই চাকরি পাবে। সে-চাকরিও করেননি। অভিনয়ে সময় দিতে পারবেন না, এই যুক্তিতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর ছেড়ে দেওয়া সেই চাকরিই পেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
প্রবাসী বাঙালি হওয়ার জন্য প্রথমদিকে বাংলা ভাষাকে বেশ ভয়ই পেতেন । ছেলেবেলায় স্কুলে হিন্দি, ইংরেজিতেই পড়াশোনা করেছেন। ফলে প্রথম প্রথম বাংলাটা তেমন আয়ত্তে ছিল না। তখনও জানতেন না, অভিনয়ই হবে তাঁর পেশা, আর তা বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করে। কিন্তু তার পর? এমন শান দিলেন বাংলায়, ঈর্ষা করার মতো ছিল সাহিত্যের জ্ঞান। ভাষা নিয়ে ছিল অদ্ভুত প্যাশন। জামাল নামের এক টেকনিশিয়ানের কাছে উর্দু শিখেছিলেন। জার্মানি যাওয়ার আগে জার্মান, রাশিয়া যাওয়ার আগে রাশিয়ান।
স্টারডমের তোয়াক্কা করেননি আজীবন। আর পাঁচটা মানুষের মতোই হেসে-খেলে কাটাতে ভালোবাসতেন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ-দের সঙ্গে কাজ করে গেছেন একের পর এক। স্ক্রিনে মন কেড়েছেন আলাদাভাবে। সে ‘হিরো’ই হোক, বন্ধুই হোক বা দাদা। এই যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে একজন আত্মমগ্ন সুরপাগল ছেলে। যে বোনের আনন্দে-যন্ত্রণায় পাশে থেকেছে বারবার। সুউচ্চ পাহাড়ের কোলে নীতা এই দাদার দিকে তাকিয়েই সোচ্চার কণ্ঠে জানাচ্ছে “দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম”। তখন পাহাড়ের কোলে ইকো হচ্ছে দাদার ইমেজ। কিংবা দাদার মধ্যে স্বয়ং পাহাড় দেখতে পেয়েছিল নীতা। তাই তাঁর কোলে মাথা রেখে নিজের আকুতি প্রকাশ করেছিল সে। ‘কোমল গান্ধার’-এ এই দাদাই হয়ে উঠল আরেকটি আত্মমগ্ন চরিত্র-অভিনেতা। দেশভাগ, আদর্শবাদ, দুর্নীতি, শিল্প ও জীবনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তিনি অসামান্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন ঋষি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে।
সত্যজিতের ‘মহানগর’-এ ডুবে গেলেন চূড়ান্ত মধ্যবিত্ততায়। বাড়ি থেকে বাইরে বেরনো স্ত্রীকে সন্দেহ করলেন। ভুগলেন কঠিন এক হীনমন্যতায়। আসলে তিনি যা চরিত্রই পেয়েছেন, তা বাস্তবোচিত করে তুলতে পারতেন। তাই দর্শক তাঁকে আজও ভুলতে পারেননি। অভিনয় করেছেন ‘নাগরিক’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘তিন কন্যা’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘জতুগৃহ’, ‘বন পলাশির পদাবলি’-সহ অনেক হিন্দি ছবিতেও।
আরো পড়ুন : লক্ষ্মীর সরা ও পটের উদ্ভব হয় পূর্ববঙ্গে
মানুষ হিসেবে বলা যায় অজাতশত্রু। আর, নিজের অভিনয় নিয়ে খুঁতখুঁতে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের চরিত্রে অভিনয়ের অফার ফিরিয়ে দিলেন প্রথমে। অমন মানুষের চরিত্রে অভিনয়ের যোগ্যতাই নাকি তাঁর নেই। অনেক কষ্টে রাজি করানো গেল। সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখে চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তীদেবী আর মেয়ে অপর্ণা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অপর্ণা নাকি বলেছিলেন, ‘‘কত দিন বাদে বাবাকে দেখলাম যেন!’’
অভিনয়ের জন্য বিপুল খ্যাতি, সম্মান, শ্রদ্ধা কুড়িয়েও তিনি শেষ অবধি মাটির মানুষটিই থেকে গেছেন আজীবন। নিজের বাড়ি হয়নি, ব্যাংকে মোটা টাকাও জমাতে পারেননি। কিন্তু জমিয়ে রেখে গেছেন অভিনীত অসংখ্য চিরস্মরণীয় চরিত্র। আর অসংখ্য ছবি। এ তাঁর আরেক নেশা। পেন, পেন্সিল, জলরং, চারকোল নিয়ে সুযোগ পেলেই বসে যেতেন। এই ‘দ্বিতীয়’ ভালোবাসাটি অবশ্য অনেকটাই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল ‘প্রথম প্রেম’ সিনেমার আলোয়।
বাংলা সিনেমায় পাকাপাকিভাবে দাগ রেখে গেছেন।
সংকলন : উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
