(গত পর্বের পর)
পক্ষপাতের পাঁচ পা
এই আম্বেদকর উধাও রহস্যের অন্যতম একটি মূল রয়েছে গৌরী বিশ্বনাথনের ওপরের উদ্ধৃতির একটি শব্দে – ‘পক্ষপাত’। ঐতিহাসিকভাবে যে কোনো প্রমিত জ্ঞানচর্চার, বিশেষত পশ্চিমি ঘরানার জ্ঞানচর্চার আদর্শ হিসাবে একটি আবশ্যিক শর্ত হিসাবে ধরা হয় পক্ষপাতশূন্যতাকে। কারণ, যুক্তিসিদ্ধ জ্ঞানচর্চাকারী নাকি কোনো পূর্বসিদ্ধান্ত ভেবে বা কোনও বাঁধাধরা ভবিষ্যৎ লক্ষ্যে পৌঁছবে ভেবে কোনো জ্ঞানলাভের পথে হাঁটে না, সে আবেগহীনভাবে সব লব্ধ জ্ঞানের সত্যতা পরখ করে, সব দিক থেকে তাকে যাচাই করে, এবং এইভাবে যুক্তি ও পক্ষপাতহীনতার কষ্টিপাথরে পাশ করা সব উচ্চমানের জ্ঞান একত্র করে সে তার জ্ঞানের খাড়াই সৌধ বানায়। কিন্তু কোন পূর্বসিদ্ধান্ত বা ভবিষ্যৎ লক্ষ্য বাঁধা থাকলে নাকি সেই পক্ষপাতী জ্ঞানচর্চাকারী যুক্তির পথ থেকে টলে যাবে, অসত্যের আলোআঁধারিতে ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখবে, রজ্জুকে সর্প বলে ভুল করবে ইত্যাদি। আর এই স্খলনের ফলে তার জ্ঞানসমগ্র পুস্তকের বদলে ইস্তেহার হয়ে উঠবে।
আম্বেদকরের বর্ণবাদ-জাতিবাদ বিষয়ক জ্ঞানচর্চায় পক্ষপাতের পরিমাণ যাচাই করার আগে দুটি উদ্ধৃতি পড়া যাক। একটি আম্বেদকরের রাজনীতি নিয়ে, আরেকটি তাঁর রচনা নিয়ে। সমাজতাত্ত্বিক বিবেক কুমার আমাদের মনে করিয়ে দেন: “একবার আম্বেদকরের সঙ্গে দলিত প্রসঙ্গ আলোচনা করার পর, গান্ধিজি (তাঁর সেক্রেটারি) মহাদেব দেশাইকে বলেন যে আশ্চর্যজনকভাবে আম্বেদকরের মতে তাঁর নাকি কোনো মাতৃভূমি নেই। দেশাই ব্যাখা করেন যে তার কারণ আম্বেদকর জন্মসূত্রে অচ্ছুত। খুব অবাক হয়ে গান্ধিজি বলেন যে, তিনি এদ্দিন ভাবতেন যে আম্বেদকর একজন বিবেকবান ব্রাহ্মণ যিনি অচ্ছুতদের মুখপাত্র।”
আরো পড়ুন : ভারতের সন্ধানে আম্বেদকর – প্রথম পর্ব
অধ্যাপক যশোদত্ত সোমাজি আলোনের লেখায় আমরা পাই: ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত আম্বেদকর তাঁর ‘হু ওয়্যার দ্য শূদ্রাজ’ (‘শূদ্র কারা?’) বইয়ের ভূমিকায় লেখেন, “আমি আমার ব্রাহ্মণবিরোধী রাজনীতির মুখড়া হিসাবে এই বইটি লিখিনি।” কিন্তু খ্যাতনামা মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিক আর এস শর্মা পুরো বইয়ের অনুপুঙ্খ পাঠ না করে বই থেকে একটা খুঁত তুলেই এটিকে নস্যাৎ করে দেন, “এক খ্যাতনামা রাজনীতিক এই বইটি লিখেছেন শূদ্রত্বের উৎস সন্ধানে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাঁর গবেষণা শুধু সংস্কৃত শাস্ত্রের অনুবাদের ওপর নির্ভরশীল। আরও দুঃখের কথা এই যে, লেখক দেঁড়ে-কষে শূদ্রত্বের এক মহান উৎস সন্ধানে উদ্যোগী। আজকাল নিচু জাতির শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে এই প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।”
আরো পড়ুন : ভারতের সন্ধানে আম্বেদকর – দ্বিতীয় পর্ব
আম্বেদকর নিজের রাজনীতিচর্চা আর জ্ঞানচর্চাকে আলাদা রেখে তথাকথিত নিরপেক্ষতার সাধনা করেননি। তেমন আবার নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণত্বের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে জাতিবাদ-বর্ণবাদকে শুধু একপাক্ষিক ন্যায়-অন্যায়ের হিসেব দিয়ে বুঝে ক্ষান্ত হননি, তাকে ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সব দিক থেকে বুঝতে আর বোঝাতে চেয়েছেন। সে কারণেই তাঁর রাজনীতি শুধু চলছে না-চলবে না-তে আটকে থাকেনি। অন্যদিকে গান্ধি এবং শর্মার মতে, আম্বেদকরের মতো এক শূদ্রের না থাকার কথা নিজের শূদ্রত্বকে নিজে বোঝার ক্ষমতা কিংবা সেই শূদ্রত্বের অবিচার ঘোচানোর জন্য রাজনৈতিক লড়াই করার ক্ষমতা। দু’টি ক্ষেত্রেই যাঁর কাজ (পড়ুন বামুনের) তাঁরই সাজে, অন্য লোকের লাঠি বাজে (আম্বেদকরের নিজের জাত মাহাররা আবার বৃত্তিগতভাবে লড়াইতে পাকা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পুরনো হিসস্যা)। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আম্বেদকরের দেখানো আদর্শ অনুযায়ী ব্যক্তিভূত ব্রাহ্মণত্বকে গাল পেড়ে (ব্রাহ্মণ্যবাদী হলেও গান্ধি কিন্তু জাতে বামুন নন, তিনি বানিয়া অর্থাৎ বৈশ্য) কাজ সারলে আমাদের চলবে না। আম্বেদকরের জ্ঞানচর্চায় তাঁর নিজের সংজ্ঞায়িত নিরপেক্ষতাকে পরতে পরতে খুলে দেখতে হবে।
(চলবে)
ভালোবাসার পক্ষে থাকুন, নিবিড়-এর সঙ্গে থাকুন
